মৃণালিনী
সপ্তম পরিচ্ছেদ : যবনবিপ্লব
সেই নিশীথে নবদ্বীপ নগর বিজয়োন্মত্ত যবনসেনার নিষ্পীড়নে বাত্যাসন্তাড়িত তরঙ্গোৎক্ষেপী সাগর সদৃশ চঞ্চল হইয়া উঠিল। রাজপথ, ভূরি ভূরি অশ্বারোহিগণে, ভূরি পদাতিদলে, ভূরি ভূরি খড়্গী, ধানুকী, শূলিসমূহসমারোহে আচ্ছন্ন হইয়া গেল। সেনাবলহীন রাজধানীর নাগরিকেরা ভীত হইয়া গৃহমধ্যে প্রবেশ করিল; দ্বার রুদ্ধ করিয়া সভয়ে ইষ্টনাম জপ করিতে লাগিল।
যবনেরা রাজপথে যে দুই একজন হতভাগ্য আশ্রয়হীন ব্যক্তিকে প্রাপ্ত হইল, তাহাদিগকে শূলবিদ্ধ করিয়া রুদ্ধদ্বার ভবনসকল আক্রমণ করিতে লাগিল। কোথায়ও বা দ্বার ভগ্ন করিয়া, কোথায়ও বা প্রাচীর উল্লঙ্ঘন করিয়া, কোথায়ও শঠতাপূর্বক ভীত গৃহস্থকে জীবনাশা দিয়া গৃহপ্রবেশ করিতে লাগিল। গৃহপ্রবেশ করিয়া, গৃহস্থের সর্বস্বাপহরণ, পশ্চাৎ স্ত্রী-পুরুষ, বৃদ্ধ, বনিতা, বালক সকলেরই শিরশ্ছেদ, ইহাই নিয়মপূর্বক করিতে লাগিল। কেবল যুবতীর পক্ষে দ্বিতীয় নিয়ম।
শোণিতে গৃহস্থের গৃহসকল প্লাবিত হইতে লাগিল। শোণিতে রাজপথ পঙ্কিল হইল। শোণিতে যবনসেনা রক্তচিত্রময় হইল। অপহৃত দ্রব্যজাতের ভারে অশ্বের পৃষ্ঠ এবং মনুষ্যের স্কন্ধ পীড়িত হইতে লাগিল। শূলাগ্রে বিদ্ধ হইয়া ব্রাহ্মণের মুণ্ডসকল ভীষণভাব ব্যক্ত করিতে লাগিল। ব্রাহ্মণের যজ্ঞোপবীত অশ্বের গলদেশে দুলিতে লাগিল। সিংহাসনস্থ শালগ্রামশিলাসকল যবন-পদাঘাতে গড়াইতে লাগিল।
ভয়ানক শব্দে নৈশাকাশ পরিপূর্ণ হইতে লাগিল। অশ্বের পদধ্বনি, সৈনিকের কোলাহল হস্তীর বৃংহিত, যবনের জয়শব্দ. তদুপরি পীড়িতের আর্তনাদ। মাতার রোদন, শিশুর রোদন; বৃদ্ধের করুণাকাঙ্ক্ষা, যুবতীর কণ্ঠবিদার।
যে বীরপুরুষকে মাধবাচার্য এত যত্নে যবনদমনার্থ নবদ্বীপে লইয়া আসিয়াছিলেন, এ সময়ে তিনি কোথা?
এই ভয়ানক যবনপ্রলয়কালে, হেমচন্দ্র রণোন্মুখ নহেন। একাকী রণোন্মুখ হইয়া কি করিবেন?
হেমচন্দ্র তখন আপন গৃহের শয়নমন্দিরে, শয্যোপরি শয়ন করিয়া ছিলেন। নগরাক্রমণের কোলাহল তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিল। তিনি দিগ্বিজয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিসের শব্দ?”
দিগ্বিজয় কহিল, “যবনসেনা নগর আক্রমণ করিয়াছে |”
হেমচন্দ্র চমৎকৃত হইলেন। তিনি এ পর্যন্ত বখ্ তিয়ারকর্তৃক রাজপুরাধিকার এবং রাজার পলায়নের বৃত্তান্ত শুনেন নাই। দিগ্বিজয় তদ্বিশেষ হেমচন্দ্রকে শুনাইল।
হেমচন্দ্র কহিলেন, “নাগরিকেরা কি করিতেছে?”
দি। যে পারিতেছে পলায়ন করিতেছে, যে না পারিতেছে সে প্রাণ হারাইতেছে।
হে। আর গৌড়ীয় সেনা?
দি। কাহার জন্য যুদ্ধ করিবে? রাজা ত পলাতক। সুতরাং তাহারা আপন আপন পথ দেখিতেছে।
হে। আমার অশ্বসজ্জা কর।
দিগ্বিজয় বিস্মিত হইল, জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যাইবেন?”
হে। নগরে।
দি। একাকী?
হেমচন্দ্র ভ্রূকুটি করিলেন। ভ্রূকুটি দেখিয়া দিগ্বিজয় ভীত হইয়া অশ্বসজ্জা করিতে গেল।
হেমচন্দ্র তখন মহামূল্য রণসজ্জায় সজ্জিত হইয়া সুন্দর অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন। এবং ভীষণ শূলহস্তে নির্ঝরিণীপ্রেরিত জলবিম্ববৎ সেই অসীম যবন-সেনা-সমুদ্রে ঝাঁপ দিলেন।