মৃণালিনী
“আচার্য সেইরূপ অঙ্গীকার করিলেন। সেই পর্যন্ত তিনি তাহাকে পরিবারস্থ করিয়া, প্রতিপালন করিয়া, তোমার সঙ্গে বিবাহের কথা লুকাইয়াছেন |”
প। এখন সে কন্যা কোথায়?
ম। আমিই কেশবের মেয়ে-জনার্দন শর্মা তাঁহার আচার্য।
পশুপতি চিত্ত হারাইলেন; তাঁহার মস্তক ঘুরিতে লাগিল। তিনি বাঙ্ানিষ্পত্তি না করিয়া প্রতিমাসমীপে সাষ্টাঙ্গ প্রাণপাত করিলেন। পরে গাত্রোত্থান করিয়া মনোরমাকে বক্ষে ধারণ করিতে গেলেন। মনোরমা পূর্ববৎ সরিয়া দাঁড়াইল। কহিল, “এখন নয়-আরও কথা আছে |”
প। মনোরমা-রাক্ষসি! এতদিন কেন আমাকে এ অন্ধকারে রাখিয়াছিলে?
ম। কেন! তুমি কি আমার কথায় বিশ্বাস করিতে?
প। মনোরমা, তোমার কথায় কবে আমি অবিশ্বাস করিয়াছি? আর যদিই আমার অপ্রত্যয় জন্মিত, তবে আমি জনার্দন শর্মাকে জিজ্ঞাসা করিতে পারিতাম।
ম। জনার্দন কি তাহা প্রকাশ করিতেন? তিনি শিষ্যের নিকট সত্যে বদ্ধ আছেন।
প। তবে তোমার কাছে প্রকাশ করিলেন কেন?
ম। তিনি আমার নিকট প্রকাশ করেন নাই। একদিন গোপনে ব্রাহ্মণীর নিকট প্রকাশ করিতেছিলেন। আমি দৈবাৎ গোপনে শুনিয়াছিলাম। আরও আমি বিধবা বলিয়া পরিচিতা। তুমি আমার কথায় প্রত্যয় করিলে লোকে প্রত্যয় করিবে কেন? তুমি লোকের কাছে নিন্দনীয় না হইয়া কি প্রকারে আমাকে গ্রহণ করিতে?
প। আমি সকল লোককে একত্র করিয়া তাহাদিগকে বুঝাইয়া দিতাম।
ম। ভাল, তাহাই হউক-জ্যোতির্বিদের গণনা?
প। আমি গ্রহশান্তি করাইতাম। ভাল, যাহা হইবার, তাহা হইয়া গিয়াছে। এক্ষণে যদি আমি রত্ন পাইয়াছি, তবে আর তাহার গলা হইতে নামাইব না। তুমি আর আমার ঘর ছাড়িয়া যাইতে পারিবে না।
মনোরমা কহিল, “এ ঘর ছাড়িতে হইবে। পশুপতি! আমি যাহা আজি বলিতে আসিয়াছিলাম, তাহা বলি শুন। এ ঘর ছাড়। তোমার রাজ্যলাভের দুরাশা ছাড়। প্রভুর অহিত চেষ্টা ছাড় । এ দেশ ছাড়িয়া চল, আমরা কাশীধামে যাত্রা করি। সেইখানে আমি তোমার চরণসেবা করিয়া জন্ম সার্থক করিব। যে দিন আমাদিগের আয়ু:শেষ হইবে, একত্রে পরমধামে যাত্রা করিব। যদি ইহা স্বীকার কর-আমার ভক্তি অচল থাকিবে। নহিলে___”
প। নহিলে কি?
মনোরমা তখন উন্নতমুখে, সবাষ্পলোচনে, দেবীপ্রতিমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া, যুক্তকরে গদ্গদকণ্ঠে কহিল, “নহিলে, দেবীসমক্ষে শপথ করিতেছি, তোমায় আমায় এই সাক্ষাৎ, এ জন্মে আর সাক্ষাৎ হইবে না |”
পশুপতিও দেবীর সমক্ষে বদ্ধাঞ্জলি হইয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, “মনোরমা-আমিও শপথ করিতেছি, আমার জীবন থাকিতে তুমি আমার বাড়ী ছাড়িয়া যাইতে পারিবে না। মনোরমা, আমি যে পথে পদার্পণ করিয়াছি, সে পথ হইতে ফিরিবার থাকিলে আমি ফিরিতাম-তোমাকে লইয়া সর্বত্যাগী হইয়া কাশীযাত্রা করিতাম। কিন্তু অনেকদূর গিয়াছি, আর ফিরিবার উপায় নাই-যে গ্রন্থি বাঁধিয়াছি, তাহা আর খুলিতে পারি না-স্রোতে ভেলা ভাসাইয়া আর ফিরাইতে পারি না। যাহা ঘটিবার তাহা ঘটিয়াছে। তাই বলিয়া কি আমার পরমসুখে আমি বঞ্চিত হইব? তুমি আমার স্ত্রী, আমার কপালে যাই থাকুক, আমি তোমাকে গৃহিণী করিব। তুমি ক্ষণেক অপেক্ষা কর-আমি শীঘ্র আসিতেছি।” এই বলিয়া পশুপতি মন্দির হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেলেন। মনোরমার চিত্তে সংশয় জন্মিল। সে চিন্তিতান্ত:করণে কিয়ৎক্ষণ মন্দিরমধ্যে দাঁড়াইয়া রহিল। আর একবার পশুপতর নিকট বিদায় না লইয়া যাইতে পারিল না।
অল্পকাল পরেই পশুপতি ফিরিয়া আসিলেন। বলিলেন, “প্রাণাধিকে! আজি আর তুমি আমাকে ত্যাগ করিয়া যাইতে পারিবে না। আমি সকল দ্বার রুদ্ধ করিয়া আসিয়াছি |”
মনোরমা বিহঙ্গী পিঞ্জরে বদ্ধ হইল।