মৃণালিনী
তৃতীয় পরিচ্ছেদ : বিহঙ্গী পিঞ্জরে
পশুপতি মনোরমার বুদ্ধিপ্রদীপ জ্বালিবার অনেক যত্ন করিতে লাগিলেন, কিন্তু ফলোৎপত্তি কঠিন হইল। পরিশেষে বলিলেন, “মনোরমা, রাত্রি অধিক হইয়াছে। আমি শয়নে যাই |”
মনোরমা অম্লানবদনে কহিলেন, “যাও |”
পশুপতি শয়নে গেলেন না। বসিয়া মালা গাঁথা দেখিতে লাগিলেন। আবার উপায়ান্তর স্বরূপ, ভয়সূচক চিন্তার আবির্ভাবে কার্য সিদ্ধ হইবেক ভাবিয়া, মনোরমাকে ভীতা করিবার জন্য পশুপতি কহিলেন, “মনোরমা, যদি ইতিমধ্যে যবন আইসে, তবে তুমি কোথায় যাইবে?”
মনোরমা মালা হইতে মুখ না তুলিয়া কহিল, “বাটীতে থাকিব |”
পশুপতি কহিলেন, “বাটীতে তোমাকে কে রক্ষা করিবে?”
মনোরমা পূর্ববৎ অন্য মনে কহিল, “জানি না; নিরুপায় |”
পশুপতি আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি আমাকে কি বলিতে মন্দিরে আসিয়াছ?”
ম। দেবতা প্রণাম করিতে।
পশুপতি বিরক্ত হইলেন। কহিলেন, “তোমাকে মিনতি করিতেছি, মনোরমা, এইবার যাহা বলিতেছি, তাহা মনোযোগ দিয়া শুন-তুমি আজিও বল, আমাকে বিবাহ করিবে কি না?”
মনোরমার মালা গাঁথা সম্পন্ন হইয়াছিল-সে তাহা একটা কৃষ্ণবর্ণ মার্জারের গলায় পরাইতেছিল। পশুপতির কথা কর্ণে গেল না। মার্জার মালা পরিধানে বিশেষ অনিচ্ছা প্রকাশ করিতেছিল-যতবার মনোরমা মালা তাহার গলায় দিতেছিল, ততবার সে মালার ভিতর হইতে মস্তক বাহির করিয়া লইতেছিল-মনোরমা কুন্দনিন্দিত দন্তে অধর দংশন করিয়া ঈষৎ হাসিতেছিল, আর আবার মালা তাহার গলায় দিতেছিল। পশুপতি অধিকতর বিরক্ত হইয়া বিড়ালকে এক চপেটাঘাত করিলেন-বিড়াল ঊর্ধ্বলাঙ্গুল হইয়া দূরে পলায়ন করিল। মনোরমা সেইরূপ দংশিতাধরে হাসিতে হাসিতে করস্থ মালা পশুপতিরই মস্তকে পরাইয়া দিল।
মার্জার-প্রসাদ মস্তকে পাইয়া রাজপ্রসাদভোগী ধর্মাধিকার হতবুদ্ধি হইয়া রহিলেন। অল্প ক্রোধ হইল-কিন্তু দংশিতাধরা হাস্যময়ীর তৎকালীন অনুপম রূপমাধুরী দেখিয়া তাঁহার মস্তক ঘুরিয়া গেল। তিনি মনোরমাকে আলিঙ্গন করিবার জন্য বাহু প্রসারণ করিলেন-অমনি মনোরমা লম্ফ দিয়া দূরে দাঁড়াইল-পথিমধ্যে উন্নতফণা কালসর্প দেখিয়া পথিক যেন দূরে দাঁড়ায়, সেইরূপ দাঁড়াইল।
পশুপতি অপ্রতিভ হইলেন; ক্ষণেক মনোরমার মুখপ্রতি চাহিতে পারিলেন না-পরে চাহিয়া দেখিলেন-মনোরমা প্রৌঢ়বয়:প্রফুল্লমুখী মহিমাময়ী সুন্দরী।
পশুপতি কহিলেন, “মনোরমা, দোষ ভাবিও না। তুমি আমার পত্নী-আমাকে বিবাহ কর।” মনোরমা পশুপতির মুখপ্রতি তীব্র কটাক্ষ করিয়া কহিল, “পশুপতি! কেশবের কন্যা কোথায়?”
পশুপতি কহিলেন, “কেশবের মেয়ে কোথায় জানি না-জানিতেও চাহি না। তুমি আমার একমাত্র পত্নী |”
ম। আমি জানি কেশবের মেয়ে কোথায়-বলিব?
পশুপতি অবাক হইয়া মনোরমার মুখপ্রতি চাহিয়া রহিলেন। মনোরমা বলিতে লাগিল, “একজন জ্যোতির্বিদ, গণনা করিয়া বলিয়াছিল যে, কেশবের মেয়ে অল্পবয়সে বিধবা হইয়া স্বামীর অনুমৃতা হইবে। কেশব এই কথায় অল্পকালে মেয়েকে হারাইবার ভয়ে বড়ই দু:খিত হইয়াছিলেন। তিনি ধর্মনাশের ভয়ে মেয়েকে পাত্রস্থ করিলেন, কিন্তু বিধিলিপি খণ্ডাইবার ভরসায় বিবাহের রাত্রেই মেয়ে লইয়া প্রয়াগে পলায়ন করিলেন। তাঁহার অভিপ্রায় এই ছিল যে, তাঁহার মেয়ে স্বামীর মৃত্যুসংবাদ কস্মিন্কালে না পাইতে পারেন। দৈবাধীন কিছুকাল পরে, প্রয়াগে কেশবের মৃত্যু হইল। তাঁহার মেয়ে পূর্বেই মাতৃহীনা হইয়াছিল-এখন মৃত্যুকালে কেশব হৈমবতীকে আচার্যের হাতে সমর্পণ করিয়া গেলেন। মৃত্যুকালে কেশব আচার্যকে এই কথা বলিয়া গেলেন, ‘এই অনাথা মেয়েটিকে আপনার গৃহে রাখিয়া প্রতিপালন করিবেন। ইহার স্বামী পশুপতি-কিন্তু জ্যোতির্বিদেরা বলিয়া গিয়াছেন যে, ইনি অল্পবয়সে স্বামীর অনুমৃতা হইবেন। অতএব আপনি আমার নিকট স্বীকার করুন যে, এই মেয়েকে কখনও বলিবেন না যে, পশুপতি ইহার স্বামী। অথবা পশুপতিকে কখনও জানাইবেন না যে, ইনি তাঁহার স্ত্রী |”