যমুনা কিছুক্ষণ ভাবিল। সে বুদ্ধিমতী; মনে মনে বিচার করিল যে, এ ত মরিবেই, তবে আমি টাকাগুলা ছাড়ি কেন? প্রকাশ্যে বলিল, “তা মা, তুমি যদি খাও, ত টাকা দিয়াই নাও, আর অমনিই নাও, নাও না কেন! আর যদি না খাও ত আমার কাছে ওষুধ পড়ে থেকেই কি ফল?”

অতএব চুক্তি ঠিক হইল। যমুনা টাকা লইয়া ঔষধ রমাকে বেচিল। রমা ঔষধের কতকগুলা পিকদানিতে ফেলিয়া দিল, কতক বালিশের নীচে গুঁজিল। উঠিতে পারে না যে, অন্যত্র রাখিবে।

এ দিকে ক্রমশঃ শরীরধ্বংসের লক্ষণ সকল দেখা দিতে লাগিল। নন্দা প্রত্যহ রমাকে দেখিতে আসে, দুই এক দণ্ড বসিয়া কথাবার্তা কহিয়া যায়। নন্দা দেখিল যে, মৃত্যুর ছায়া পড়িয়াছে; যাহার ছায়া, সে নিকটেই। নন্দা ভাবিল, “হায়! রাজবাড়ীর কবিরাজগুলোকেও কি ডাকিনীতে পেয়েছে?” নন্দা একেবারে কবিরাজের দলকে ডাকিয়া পাঠাইল। সকলে আসিলে নন্দা আড়ালে থাকিয়া তাহাদিগকে উত্তম মধ্যম রকম ভরৎসনা করিল। বলিল, “যদি রোগ ভাল করিতে পার না, তবে মাসিক লও কেন?”

একজন প্রাচীন কবিরাজ বলিল, “মা! কবিরাজে ঔষধ দিতে পারে, পরমায়ু দিতে পারে না |”

নন্দা বলিল, “তবে আমাদের ঔষধেও কাজ নাই, কবিরাজেও কাজ নাই। তোমরা আপনার আপনার দেশে যাও |”

কবিরাজমণ্ডলী বড় ক্ষুণ্ণ হইল। প্রাচীন কবিরাজটি বড় বিজ্ঞ। তিনি বলিলেন, “মা! আমাদের অদৃষ্ট নিতান্ত মন্দ, তাই এমন ঘটিয়াছে। নহিলে, আমি যে ঔষধ দিয়াছি, তাহা সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি। আমি এখনও আপনার নিকট স্বীকার করিতেছি যে, তিন দিনের মধ্যে আরাম করিব, যদি একটা বিষয়ে আপনি অভয় দেন |”

নন্দা জিজ্ঞাসা করিল, “কি চাই?”

কবিরাজ বলিল, “আমি নিজে বসাইয়া থাকিয়া ঔষধ খাওয়াইয়া আসিব |” বুড়ার বিশ্বাস, “বেটি ঔষধ খায় না; আমার ঔষধ খাইলে কি রোগী মরে!”

নন্দা স্বীকৃত হইয় কবিরাজদিগকে বিদায় দিল। পরে রমার কাছে আসিয়া সব বলিল। রমা অল্প হাসিল, বেশী হাসিবার শক্তিও নাই, মুখে স্থান নাই; মুখ বড় ছোট হইয়া গিয়াছে।

নন্দা জিজ্ঞাসা করিল, “হাসিলি যে?”

রমা আবার তেমনি হাসি হাসিয়া বলিল, “ঔষধ খাব না |”

ন। ছি দিদি! যদি এত ঔষধ খেলে, ত আর তিনটা দিন খেতে কি?

র। আমি ঔষধ খাই নাই।

নন্দা চমকিয়া উঠিল,--বলিল, “সে কি? মোটে না?”

র। সব বালিশের নীচে আছে।

নন্দা বালিশ উল্টাইয়া দেখিল, সব আছে বটে। তখন নন্দা বলিল, “কেন বহিন—এখন আর আত্মঘাতিনী হইবে কেন? পাপ ত মিটিয়াছে |”

র। তা নয়-ঔষধ খাব।

ন। আর কবে খাবি?

র। যবে রাজা আমাকে দেখিতে আসিবেন।

ঝর-ঝর করিয়া রমার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। নন্দারও চক্ষে জল আসিল। আর এখন সীতারাম রমাকে দেখিতে আসেন না। সীতারাম চিত্তবিশ্রামে থাকেন। নন্দা চোখের জল মুছিয়া বলিল, “এবার এলেই তোমাকে দেখিতে আসিবেন |”