একাদশ পরিচ্ছেদ

সেই যে সভাতলে রমা মূর্ছিতা হইয়া পড়িয়া গিয়াছিল, সখীরা ধরাধরি করিয়া আনিয়া শুয়াইল, সেই অবধি রমা আর উঠে নাই। প্রাণপণ করিয়া আপনার সতী নাম রক্ষা করিয়াছিল। মান রক্ষা হইল, কিন্তু প্রাণ বুঝি গেল।

এখন রোগ পুরাতন হইয়াছে। কিন্তু গোড়া থেকে বলি। রাজার রাণীর চিকিৎসার অভাব হয় নাই। প্রথম হইতেই কবিরাজ যাতায়াত করিতে লাগিল। অনেকগুলা কবিরাজ রাজবাড়ীতে চাকরি করে, তত কর্ম নাই, সচরাচর ভৃত্যবর্গকে মসলা খাওয়াইয়া, এবং পরিচারিকাকে পোষ্টাই দিয়া কালাতিপাত করে; এক্ষণে ছোট রাণীকে রোগী পাইয়া কবিরাজ মহাশয়েরা হঠাৎ বড়লোক হইয়া বসিলেন, তখন রোগনির্ণয় লইয়া মহা হুলস্থূল পড়িয়া গেল। মূর্ছা, বায়ু, অম্লপিত্ত, হৃদ্রো গ ইত্যাদি নানাবিধ রোগের লক্ষণ শুনিতে শুনিতে রাজপুরুষেরা জ্বালাতন হইয়া উঠিল। দেহ নিদানের দোহাই দেন, কেহ বাগ্ভোটের, কেহ চরকসংহিতার বচন আওড়ান, কেহ সুশ্রুতের টীকা ঝাড়েন। রোগ অনির্ণীত রহিল।

কবিরাজ মহাশয়েরা, কেবল বচন ঝাড়িয়া নিশ্চিন্ত রহিলেন, এমন নিন্দা আমরা করি না। তাঁহারা নানাপ্রকার ঔষধের ব্যবস্হা করিলেন। কেহ বটিকা, কেহ গুড়া, কেহ ঘৃত, কেহ তৈল; কেহ বলিলেন, ঔষধ প্রস্তুত করিতে হইবে, কেহ বলিবেন, আমার কাছে যাহা প্রস্তুত করিতে হইবে, কেহ বলিলেন, আমার কাছে যাহা প্রস্তুত আছে, তেমন আর হইবে না। যাই হউক, রাজার বাড়ী, রাণীর রোগ, ঔষধের প্রয়োজন থাক, না থাক, নূতন প্রস্তুত হইবে না, এমন হইতে পারে না। হইলে দশ জনে দুটাকা দুসিকা উপার্জন করিতে পারে, অতএব ঔষধ প্রস্তুতের ধুম পড়িয়া গেল। কোথাও হামানদিস্তায় মূল পিষ্ট হইতেছে, কোথাও ঢেঁকিতে ছাল কুটিতেছে, কোথাও হাঁড়িতে কিছু সিদ্ধ হইতেছে, কোথাও খুলিতে তৈলে মূর্ছনা পড়িতেছে। রাজবাড়ীর এক জন পরিচারিকা এক দিন দেখিয়া বলিল, “রাণী হইয়া রোগ হয়, সেও ভাল |”

যার জন্য ঔষধের এত ধুম, তার সঙ্গে ঔষধের সাক্ষাৎ সম্বন্ধ বড় অল্প। কবিরাজ মহাশয়েরা ঔষধ যোগাইতেন না, তা নয়। সে গুণে তাঁহাদের কিছুমাত্র ত্রুটি ছিল না। তবে রমার দোষে সে যত্ন বৃথা হইল--রমা ঔষধ খাইত না। মুরলার বদলে, যমুনা নাম্নী একজন পরিচারিকা, রাণীর প্রধানা দাসী হইয়াছিল। যমুনাকে একটু প্রাচীন দেখিয়া নন্দা তাহাকে এই পদে অভিষিক্ত করিয়াছিলেন। আমরা এমন বলিতে পারি না যে, যমুনা আপনাকে প্রাচীনা বলিয়া স্বীকার করিত; শুনিয়াছি, কোন ভৃত্যবিশেষের এ বিষয়ে সম্পূর্ণ মতান্তর ছিল; তথাপি স্থূল কথা এই যে, যমুনা একটু প্রাচীন চালে চলিত, রমাকে বিলক্ষণ যত্ন করিত; রোগিণীর সেবার কোন প্রকার ত্রুটি না হয়, তদ্বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী ছিল। রমার জন্য কবিরাজেরা যে ঔষধ দিয়া যাইত, তাহারই হাতে পড়িত; সেবন করাইবার ভার তাহার উপর। কিন্তু সেবন করান তাহার সাধ্যাতীত; রমা কিছুতেই ঔষধ খাইত না।

এ দিকে রোগের কোন উপশম নাই, ক্রমেই বৃদ্ধি, রমা আর মাথা তুলিতে পারে না। দেখিয়া শুনিয়া যমুনা স্থির করিল যে, সকল কথা বড় রাণীকে গিয়া জানাইবে। অতএব রমাকে বলিল, “আমি বড় মহারাণীর কাছে চলিলাম; ঔষধ তিনি নিজে আসিয়া খাওয়াইবেন |”

রমা বলিল, “বাছা! মৃত্যুকালে আর কেন জ্বালাতন করিস! বরং তোর সঙ্গে একটা বন্দোবস্ত করি |”

যমুনা জিজ্ঞাসা করিল, “কি বন্দোবস্ত মা?”

র। তোমার এই ঔষধগুলি আমারে বেচিবে? আমি এক এক টাকা দিয়া একটা বড়ি কিনিতে রাজি আছি।

য। সে আবার কি মা! তোমার ঔষধ তোমায় আবার বেচিব কি?

র। টাকা নিয়া তুমি যদি আমায় বড়ি বেচ, তা হলে তোমার আর তাতে কোন অধিকার থাকিবে না। চাই আমি খাই, চাই না খাই, তুমি আর কথা কহিতে পাবে না।