দেবী চৌধুরাণী
দশম পরিচ্ছেদ
এখন একটু ফুলমণির কথা বলি। ফুলমণি নাপিতাণী হরিণীর ন্যায় বাছিয়া বাছিয়া দ্রুতপদে জীবে প্রাণ-সমর্পণ করিয়াছিল। ডাকাইতের ভয়ে দুর্লভচন্দ্র আগে আগে পলাইলেন, ফুলমণি পাছু পাছু ছুটিয়া গেল। কিন্তু দুর্লভের এমনই পলাইবার রোখ্ যে, তিনি পশ্চাদ্ধাবিতা প্রণিয়নীর কাছে নিতান্ত দুর্লভ হইলেন। ফুলমণি যত ডাকে, “ও গো দাঁড়াও গো! আমায় ফেলে যেও না গো!” দুর্লভচন্দ্র তত ডাকে, “ও বাবা গো! ঐ এলো গো!” কাঁটা-বনের ভিতর দিয়া, পগার লাফাইয়া, কাদা ভাঙ্গিয়া, ঊর্দ্ধশ্বাসে দুর্লভ ছোটে–হায়! কাছা খুলিয়া গিয়াছে, এক পায়ের নাগরা জুতা কোথায় পড়িয়া গিয়াছে, চাদরখানা একটা কাঁটা-বনে বিঁধিয়া তাঁহার বীরত্বের নিশানস্বরূপ বাতাসে উড়িতেছে। তখন ফুলমণি সুন্দরী হাঁকিল, “ও অধঃপেতে মিন্াসে–ওরে মেয়েমানুষকে ভুলিয়ে এনে–এমনি করে কি ডাকাতের হাতে সঁপে দিয়ে যেতে হয় রে মিন্িসে?” শুনিয়া দুর্লভচন্দ্র ভাবিলেন, তবে নিশ্চিত ইহাকে ডাকাইতে ধরিয়াছে। অতএব দুর্লভচন্দ্র বিনাবাক্যব্যয়ে আরও বেগে ধাবমান হইলেন। ফুলমণি ডাকিল, “ও অধঃপেতে–ও পোড়ার মুখো–ও আঁটকুড়ীর পুত–ও হাবাতে–ও ড্যাকরাক–ও বিট্পলে।” ততক্ষণ দুর্লভ অদৃশ্য হইল। কাজেই ফুলমণিও গলাবাজি ক্ষান্ত দিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল। রোদনকালে দুর্লভের মাতা-পিতার প্রতি নানাবিধ দোষারোপ করিতে লাগিল।
এদিকে ফুলমণি দেখিল, কই–ডাকাইতেরা ত কেহ আসিল না। কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া ভাবিল–কান্না বন্ধ করিল। শেষ দেখিল, না ডাকাইত আসে–না দুর্লভচন্দ্র দেখা দেয়। তখন জঙ্গল হইতে বাহির হইবার পথ খুঁজিতে লাগিল। তাহার ন্যায় চতুরার পক্ষে পথ পাওয়া বড় কঠিন হইল না। সহজেই বাহির হইয়া সে রাজপথে উপস্থিত হইল। কোথাও কেহ নাই দেখিয়া, সে গৃহাভিমুখে ফিরিল। দুর্লভের উপর তখন বড় রাগ।
অনেক বেলা হইলে ফুলমণি ঘরে পৌঁছিল। দেখিল, তাহার ভগিনী অলকমণি ঘরে নাই, স্নানে গিয়াছে। ফুলমণি কাহাকে কিছু না বলিয়া কপাট ভেজাইয়া শয়ন করিল। রাত্রে নিদ্রা হয় নাই–ফুলমণি শুইবামাত্র ঘুমাইয়া পড়িল।
তাহার দিদি আসিয়া তাহাকে উঠাইল–জিজ্ঞাসা করিল, “কি লা, তুই এখন এলি?”ফুলমণি বলিল, “কেন, আমি কোথায় গিয়াছিলাম?”
অলকমণি। কোথায় আর যাবি? বামুনদের বাড়ী শুতে গিয়েছিলি, তা এত বেলা অবধি এলি না, তাই জিজ্ঞাসা কর্ছি।
ফুল। তুই চোখের মাথা খেয়েছিস তার কি হবে? ভোরের বেলা তোর সমুখ দিয়ে এসে শুলেম–দেখিস নে?