কৃষ্ণকান্তের উইল
ভ্রমর বলিল, “সাত বৎসর হইল, ওখানে ফুলবাগান ছিল। বে-মেরামতে গিয়াছে। আমি সাত বৎসর দেখি নাই |”
অনেক্ষণ ভ্রমর নীরব হইয়া রহিলেন। তার পর ভ্রমর বলিলেন, “যেখানে হইতে পার দিদি, আজ আমার ফুল আনাইয়া দিতে হইবে। দেখিতেছ না, আজি আবার আমার ফুলশয্যা?”
যামিনী আজ্ঞা পাইয়া দাস দাসী রাশীকৃত ফুল আনিয়া দিল। ভ্রমর বলিল, “ফুল আমার বিছানায় ছড়াইয়া দাও–আজ আমার ফুলশয্যা |”
যামিনী তাহাই করিল। তখন ভ্রমরের চক্ষু দিয়া জলধারা পড়িতে লাগিল। যামিনী বলিল, “কাঁদিতেছ কেন দিদি?”
ভ্রমর বলিল, “দিদি, একটি বড় দুঃখ রহিল। যে দিন তিনি আমায় ত্যাগ করিয়া কাশী যান, সেই দিন যোড়হাতে কাঁদিতে কাঁদিতে দেবতার কাছে ভিক্ষা চাহিয়াছিলাম, এক দিন যেন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। স্পর্ধা করিয়া বলিয়াছিলাম, আমি যদি সতী হই, তবে আবার তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হইবে। কই, আর ত দেখা হইল না। আজিকার দিন–মরিবার দিনে, দিদি, যদি একবার দেখিতে পাইতাম! এক দিনে, দিদি, সাত বৎসরের দুঃখ ভুলিতাম!”
যামিনী বলিল, “দেখিবে?” ভ্রমর যেন বিদুৎ চমকিয়া উঠিল–বলিল, “কার কথা বলিতেছ?”
যামিনী স্থিরভাবে বলিল, “গোবিন্দলালের কথা। তিনি এখানে আছেন–বাবা তোমার পীড়ার সংবাদ তাঁহাকে দিয়াছিলেন। শুনিয়া তোমাকে একবার দেখিবার জন্য তিনি আসিয়াছেন। আজ পৌঁছিয়াছেন। তোমার অবস্থা দেখিয়া ভয়ে এতক্ষণ তোমাকে বলিতে পারি নাই–তিনিও সাহস করিয়া আসিতে পারেন নাই|”
ভ্রমর কাঁদিয়া বলিল, “একবার দেখা দিদি! ইহজন্মে আর একবার দেখি! এই সময়ের আর একবার দেখা!”
যামিনী উঠিয়া গেল। অল্পক্ষণ পরে, নিঃশব্দপাদবিক্ষেপে গোবিন্দলাল–সাত বৎসরের পর নিজ শয্যাগৃহে প্রবেশ করিলেন।
দুজনেই কাঁদিতেছিল। এক জনও কথা কহিতে পারিল না।
ভ্রমর, স্বামীকে কাছে আসিয়া বিছানায় বসিতে ইঙ্গিত করিল।-গোবিন্দলাল কাঁদিতে কাঁদিতে বিছানায় বসিল। ভ্রমর তাঁহাকে আরও কাছে আসিতে বলিল,-গোবিন্দলাল আরও কাছে আসিল। তখন ভ্রমর আপন করতলের নিকট স্বামীর চরণ পাইয়া, সেই চরণযুগল স্পর্শ করিয়া পদরেণু লইয়া মাথায় দিল। বলিল, “আজ আমার সকল অপরাধ মার্জনা করিয়া, আশীর্বাদ করিও জন্মান্তরে যেন সুখী হই |”
গোবিন্দলাল কোন কথা কহিতে পারিলেন না। ভ্রমরের হাত, আপন হাতে তুলিয়া লইলেন। সেইরূপ হাতে হাত রহিল। অনেক্ষণ রহিল। ভ্রমর নিঃশব্ধে প্রাণত্যাগ করিল।