দুর্গেশনন্দিনী
রাজপুত্র বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “এ সকল কথার তাৎপর্য কি?”
ওসমান কহিলেন, “আমরা পাঠান–অন্ত:করণ প্রজ্বলিত হইলে উচিতানুচিত বিবেচনা করি না; এই পৃথিবী মধ্যে আয়েষার প্রণয়াকাঙ্ক্ষী দুই ব্যক্তির স্থান হয় না, একজন এইখানে প্রাণত্যাগ করিব |”
তখন রাজপুত্র আদ্যোপান্ত বুঝিতে পারিয়া অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হইলেন, কহিলেন, “আপনার কি অভিপ্রায়?”
ওসমান কহিলেন, “সশস্ত্র আছ, আমার সহিত যুদ্ধ কর। সাধ্য হয়, আমাকে বধ করিয়া আপনার পথ মুক্ত কর, নচেৎ আমার হস্তে প্রাণত্যাগ করিয়া আমার পথ ছাড়িয়া যাও |”
এই বলিয়া ওসমান জগৎসিংহকে প্রত্যুত্তরের অবকাশ দিলেন না, অসিহস্তে তৎপ্রতি আক্রমণ করিলেন। রাজপুত্র অগত্যা আত্মরক্ষার্থ শীঘ্রহস্তে কোষ হইতে অসি বাহির করিয়া ওসমানের আঘাতের প্রতিঘাত করিতে লাগিলেন। ওসমান রাজপুত্রের প্রাণনাশে পুন: পুন: বিষমোদ্যম করিতে লাগিলেন; রাজপুত্র ভ্রমক্রমেও ওসমানকে আঘাতের চেষ্টা করিলেন না; কেবল আত্মরক্ষায় নিযুক্ত রহিলেন। উভয়েই শস্ত্রবিদ্যায় সুশিক্ষিত, বহুক্ষণ যুদ্ধ হইলে, কেহ কাহাকেও পরাজিত করিতে পারিলেন না। ফলত: যবনের অস্ত্রাঘাতে রাজপুত্রের শরীর ক্ষতবিক্ষত হইল; রুধিরে অঙ্গ প্লাবিত হইল; ওসমান প্রতি তিনি একবারও আঘাত করেন নাই, সুতরাং ওসমান অক্ষত। রক্তস্রাবে শরীর অবসন্ন হইয়া আসিল দেখিয়া আর এরূপ সংগ্রামে মৃত্যু নিশ্চয় জানিয়া জগৎসিংহ কাতরস্বরে কহিলেন, “ওসমান, ক্ষান্ত হও, আমি পরাভব স্বীকার করিলাম |”
ওসমান উচ্চ হাস্য করিয়া কহিলেন, “এ ত জানিতাম না যে রাজপুত্র সেনাপতি মরিতে ভয় পায়; যুদ্ধ কর, আমি তোমায় বধ করিব, ক্ষমা করিব না। তুমি জীবিতে আয়েষাকে পাইব না |”
রাজপুত্র কহিলেন, “আমি আয়েষার অভিলাষী নহি |”
ওসমান অসি ঘূর্ণিত করিতে করিতে কহিতে লাগিলেন, “তুমি আয়েষার অভিলাষী নও, আয়েষা তোমার অভিলাষী। যুদ্ধ কর, ক্ষমা নাই |”
রাজপুত্র অসি দূরে নিক্ষেপ করিয়া কহিলেন, “আমি যুদ্ধ করিব না। তুমি অসময়ে আমার উপকার করিয়াছ; আমি তোমার সহিত যুদ্ধ করিব না |”
ওসমান সক্রোধে রাজপুত্রকে পদাঘাত করিলেন, কহিলেন, “যে সিপাহী যুদ্ধ করিতে ভয় পায়, তাহাকে এইরূপে যুদ্ধ করাই |”
রাজকুমারের আর ধৈর্য রহিল না। শীঘ্রহস্তে ত্যক্ত প্রহরণ ভূমি হইতে উত্তোলন করিয়া শৃগালদংশিত সিংহবৎ প্রচণ্ড লম্ফ দিয়া রাজপুত্র যবনকে আক্রমণ করিলেন। সে দুর্দম প্রহার যবন সহ্য করিতে পারিলেন না। রাজপুত্রের বিশাল শরীরাঘাতে ওসমান ভূমিশায়ী হইলেন। রাজপুত্র তাঁহার বক্ষোপরি আরোহণ করিয়া হস্ত হইতে অসি উন্মোচন করিয়া লইলেন, এবং নিজ করস্থ প্রহরণ তাঁহার গলদেশে স্থাপিত করিয়া কহিলেন, “কেমন, সমর-সাধ মিটিয়াছে ত?”
ওসমান কহিলেন, “জীবন থাকিতে নহে |”
রাজপুত্র কহিলেন, “এখনই ত জীবন শেষ করিতে পারি?”
ওসমান কহিলেন, “কর, নচেৎ তোমার বধাভিলাষী শত্রু জীবিত থাকিবে |”
জগৎসিংহ কহিলেন, “থাকুক, রাজপুত তাহাতে ডরে না; তোমার জীবন শেষ করিতাম, কিন্তু তুমি আমার জীবন রক্ষা করিয়াছিলে, আমিও করিলাম |”