ওসমান পূর্ববৎ ভঙ্গীতে কহিলেন, “নিশীথে একাকিনী বন্দিসহবাস নবাবপুত্রীর পক্ষে উত্তম। বন্দীর জন্য নিশীথে কারাগারে অনিয়ম প্রবেশও উত্তম |”

আয়েষার পবিত্র চিত্তে এ তিরস্কার সহনাতীত হইল। ওসমানের মুখপানে চাহিয়া উত্তর করিলেন। সেরূপ গর্বিত স্বর ওসমান কখন আয়েষার কণ্ঠে শুনেন নাই।

আয়েষা কহিলেন, “এ নিশীথে একাকিনী কারাগার মধ্যে আসিয়া এই বন্দীর সহিত আলাপ করা, আমার ইচ্ছা। আমার কর্ম উত্তম কি অধম, সে কথায় তোমার প্রয়োজন নাই |”

ওসমান বিস্মিত হইলেন, বিস্মিতের অধিক ক্রুদ্ধ হইলেন; কহিলেন, “প্রয়োজন আছে কি না, কাল প্রাতে নবাবের মুখে শুনিবে |”

আয়েষা পূর্ববৎ কহিলেন, “যখন পিতা আমাকে জিজ্ঞাসা করিবেন, আমি তখন তাহার উত্তর দিব। তোমার চিন্তা নাই |”

ওসমানও পূর্ববৎ ব্যঙ্গ করিয়া কহিলেন, “আর যদি আমি জিজ্ঞাসা করি?”

আয়েষা দাঁড়াইয়া উঠিলেন। কিয়ৎক্ষণ পূর্ববৎ স্থিরদৃষ্টিতে ওসমানের প্রতি নিরীক্ষণ করিলেন; তাঁহার বিশাল লোচন আরও যেন বর্ধিতায়তন হইল। মুখ-পদ্ম যেন অধিকতর প্রস্ফুটিত হইয়া উঠিল। ভ্রমরকৃষ্ণ অলকাবলীর সহিত শিরোদেশ ঈষৎ এক দিকে হেলিল; হৃদয় তরঙ্গান্দোলিত নিবিড় শৈবালজালবৎ উৎকম্পিত হইতে লাগিল; অতি পরিষ্কার স্বরে আয়েষা কহিলেন, “ওসমান, যদি তুমি জিজ্ঞাসা কর, তবে আমার উত্তর এই যে, এই বন্দী আমার প্রাণেশ্বর!”

যদি তন্মুহূর্তে কক্ষমধ্যে বজ্রপতন হইত, তবে রাজপুত কি পাঠান অধিকতর চমকিত হইতে পারিতেন না। রাজপুত্রের মনে অন্ধকার-মধ্যে যেন কেহ প্রদীপ জ্বালিয়া দিল। আয়েষার নীরব রোদন এখন তিনি বুঝিতে পারিলেন। ওসমান কতক কতক ঘুণাক্ষরে পূর্বেই এরূপ সন্দেহ করিয়াছিলেন, এবং সেইজন্যই আয়েষার প্রতি এরূপ তিরস্কার করিতেছিলেন, কিন্তু আয়েষা তাঁহার সম্মুখেই মুক্তকণ্ঠে কথা ব্যক্ত করিবেন, ইহা তাঁহার স্বপ্নেরও অগোচর। ওসমান নিরুত্তর হইয়া রহিলেন।

আয়েষা পুনরপি কহিতে লাগিলেন, “শুন ওসমান, আবার বলি, এই বন্দী আমার প্রাণেশ্বর,-যাবজ্জীবন অন্য কেহ আমার হৃদয়ে স্থান পাইবে না। কাল যদি বধ্যভূমি ইঁহার শোণিতে আর্দ্র হয় ___” বলিতে বলিতে আয়েষা শিহরিয়া উঠিলেন; “তথাপি দেখিবে, হৃদয়-মন্দিরে ইঁহার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করিয়া অন্তকাল পর্যন্ত আরাধনা করিব। এই মুহূর্তের পর যদি আর চিরন্তন ইঁহার সঙ্গে দেখা না হয়, কাল যদি ইনি মুক্ত হইয়া শত মহিলার মধ্যবর্তী হন, আয়েষার নামে ধিক্কার করেন, তথাপি আমি ইঁহার প্রেমাকাঙ্ক্ষিণী দাসী রহিব। আরও শুন; মনে কর এতক্ষণ একাকিনী কি কথা বলিতেছিলাম? বলিতেছিলাম, আমি দৈবারিকগণকে বাক্যে পারি, ধনে পারি বশীভূত করিয়া দিব; পিতার অশ্বশালা হইতে অশ্ব দিব; বন্দী পিতৃশিবিরে এখনই চলিয়া যাউন। বন্দী নিজে পলায়নে অস্বীকৃত হইলেন। নচেৎ তুমি এতক্ষণ ইঁহার নখাগ্রও দেখিতে পাইতে না |”

আয়েষা আবার অশ্রুজল মুছিলেন। কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিযা অন্য প্রকার স্বরে কহিতে লাগিলেন, “ওসমান, এ সকল কথা বলিয়া তোমাকে ক্লেশ দিতেছি, অপরাধ ক্ষমা কর। তুমি আমায় স্নেহ কর, আমি তোমায় স্নেহ করি; এ আমার অনুচিত। কিন্তু তুমি আজি আয়েষাকে অবিশ্বাসিনী ভাবিয়াছ। আয়েষা অন্য যে অপরাধ করুক, অবিশ্বাসিনী নহে। আয়েষা যে কর্ম করে, তাহা মুক্ত কণ্ঠে বলিতে পারে। এখন তোমার সাক্ষাৎ বলিলাম, প্রয়োজন হয়, কাল পিতার সমক্ষে বলিব |”

পরে জগৎসিংহের দিকে ফিরিয়া কহিলেন, “রাজপুত্র, তুমিও অপরাধ ক্ষমা কর। যদি ওসমান আজ আমাকে মন:পীড়িত না করিতেন, তবে এ দগ্ধ হৃদয়ের তাপ কখনও তোমার নিকট প্রকাশ পাইত না, কখনও মনুষ্যকর্ণগোচর হইত না |”

রাজপুত্র নি:শব্দে দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন; অন্ত:করণ সন্তাপে দগ্ধ হইতেছিল।

ওসমানও কথা কহিলেন না। আয়েষা আবার বলিতে লাগিলেন, “ওসমান, আবার বলি, যদি দোষ করিয়া থাকি, দোষ মার্জনা করিও। আমি তোমার পূর্ববৎ স্নেহপরায়ণা ভগিনী, ভগিনী বলিয়া তুমিও পূর্বস্নেহের লাঘব করিও না। কপালের দোষে সন্তাপে-সাগরে ঝাঁপ দিয়াছি, ভ্রাতৃস্নেহে নিরাশ করিয়া আমায় অতল জলে ডুবাইও না|”

এই বলিয়া সুন্দরী দাসীর প্রত্যাগমন প্রতীক্ষা না করিয়া একাকিনী বহির্গতা হইলেন। ওসমান কিয়ৎক্ষণ বিহ্বলের ন্যায় বিনা বাক্যে থাকিয়া, নিজ মন্দিরে প্রস্থান করিলেন।