তদ্দণ্ডে যদি ইষ্টদেবী ভবানী সশরীরে আসিয়া বরপ্রদা হইতেন, তথাপি রাজপুত্র অধিক চমৎকৃত হইতে পারিতেন না। রাজপুত্র প্রথমে উত্তর করিতে পারিলেন না। আয়েষা পুনর্বার কহিলেন, “জগৎসিংহ! রাজকুমার! এসো |”

জগৎসিংহ অনেক্ষণ পরে কহিলেন, “আয়েষা! তুমি আমাকে কারাগার হইতে মুক্ত করিয়া দিবে?”

আয়েষা কহিলেন, “এই দণ্ডে |”

রা। তোমার পিতার অজ্ঞাতে?

আ। সেজন্য চিন্তা করিও না, তুমি শিবিরে গেলে – আমি তাঁহাকে জানাইব।

“প্রহরীরা যাইতে দিবে কেন?”

আয়েষা কণ্ঠ হইতে রত্নকণ্ঠী ছিঁড়িয়া দেখাইয়া কহিলেন, “এই পুরস্কার লোভে প্রহরী পথ ছাড়িয়া দিবে |”

রাজপুত্র পুনর্বার কহিলেন, “একথা প্রকাশ হইলে তুমি তোমার পিতার নিকট যন্ত্রণা পাইবে |”

“তাতে ক্ষতি কি?”

“আয়েষা! আমি যাইব না |”

আয়েষার মুখ শুষ্ক হইল। ক্ষুণ্ণ হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন?”

রা। তোমার নিকট প্রাণ পর্যন্ত পাইয়াছি, তোমার যাহাতে যন্ত্রণা হইবে, তাহা আমি কদাচ করিব না।

আয়েষা প্রায় রুদ্ধকণ্ঠে কহিলেন, “নিশ্চিত যাইবে না?”

রাজকুমার কহিলেন, “তুমি একাকিনী যাও |”

আয়েষা পুনর্বার নীরব হইয়া রহিলেন। আবার চক্ষে দর দর ধারা বিগলিত হইতে লাগিল; আয়েষা কষ্টে অশ্রুসংবরণ করিতে লাগিলেন।

রাজপুত্র আয়েষার নি:শব্দ রোদন দেখিয়া চমৎকৃত হইলেন। কহিলেন, “আয়েষা! রোদন করিতেছ কেন?”

আয়েষা কথা কহিলেন না। রাজপুত্র আবার কহিলেন, “আয়েষা! আমার অনুরোধ রাখ, রোদনের কারণ যদি প্রকাশ্য হয়, তবে আমার নিকট প্রকাশ কর। যদি আমার প্রাণদান করিলে তোমার নীরব রোদনের কারণ নিরাকরণ হয়, তাহা আমি করিব। আমি যে বন্দিত্ব স্বীকার করিলাম, কেবল ইহাতেই কখনও আয়েষার চক্ষে জল আইসে নাই। তোমার পিতার কারাগারে আমার ন্যায় অনেক বন্দী কষ্ট পাইয়াছে |”

আয়েষা আশু রাজপুত্রের কথায় উত্তর না করিয়া অশ্রুজল অঞ্চলে মুছিলেন। ক্ষণেক নীরব নিস্পন্দ থাকিয়া কহিলেন, “রাজপুত্র! আমি আর কাঁদিব না |”

রাজপুত্র প্রশ্নের উত্তর না পাইয়া কিছু ক্ষুণ্ণ হইলেন। উভয়ে আবার নীরবে মুখ অবনত করিয়া রহিলেন।

প্রকোষ্ঠ-প্রাকারে আর এক ব্যক্তির ছায়া পড়িল; কেহ তাহা দেখিতে পাইলেন না। তৃতীয় ব্যক্তি আসিয়া উভয়ের নিকটে দাঁড়াইল, তথাপি দেখিতে পাইলেন না। ক্ষণেক স্তম্ভের ন্যায় স্থির দাঁড়াইয়া, পরে ক্রোধ-কম্পিত স্বরে আগন্তুক কহিল, “নবাবপুত্রি! এ উত্তম |”

উভয়ে মুখ তুলিয়া দেখিলেন,–ওসমান।

ওসমান তাঁহার অনুচর অঙ্গুরীবাহকের নিকট সবিশেষ অবগত হইয়া আয়েষার সন্ধানে আসিয়াছিলেন। রাজপুত্র, ওসমানকে সে স্থলে দেখিয়া আয়েষার জন্য শঙ্কান্বিত হইলেন, পাছে আয়েষা, ওসমান বা কতলু খাঁর নিকট তিরস্কৃতা বা অপমানিতা হন। ওসমান যে ক্রোধপ্রকাশক স্বরে ব্যঙ্গোক্তি করিলেন, তাহাতে সেইরূপ সম্ভাবনা বোধ হইল। ব্যঙ্গোক্তি শুনিবামাত্র আয়েষা ওসমানের কথার অভিপ্রায় নি:শেষ বুঝিতে পারিলেন। মুহূর্তমাত্র তাঁহার মুখ রক্তবর্ণ হইল। আর কোন অধৈর্যের চিহ্ন প্রকাশ পাইল না। স্থির স্বরে উত্তর করিলেন, “কি উত্তম, ওসমান?”