সপ্তম পরিচ্ছেদ

কলিকাতায় গমনকালে আমি একা রজনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গেলাম না। কুটুম্বগৃহ হইতে তিনকড়ি নামে একজন প্রাচীনা পরিচারিকা সমভিব্যাহারে লইয়া গেলাম। এ সতর্কতা রজনীর মন প্রসন্ন করিবার জন্য। গমনকালে রজনীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “রজনী-তোমাদের বাড়ী কলিকাতায়-কিন্তু তুমি এখানে আসিলে কি প্রকারে?”

রজনী বলিল, “আমাকে কি সকল কথা বলিতে হইবে?”

আমি বলিলাম, “তোমার যদি ইচ্ছা না হয়, তবে বলিও না |”

বস্তুত: এই অন্ধ স্ত্রীলোকের বুদ্ধি, বিবেচনা, এবং সরলতায় আমি বিশেষ প্রীত হইয়াছিলাম। তাহাকে কোন প্রকার ক্লেশ দিবার আমার ইচ্ছা ছিল না। রজনী বলিল, “যদি অনুমতি করিলেন, তবে কতক কথা গোপন রাখিব। গোপাল বাবু বলিয়া আমার একজন প্রতিবাসী আছেন। তাঁহার স্ত্রী চাঁপা। চাঁপার সঙ্গে আমার হঠাৎ পরিচয় হইয়াছিল। তাহার বাপের বাড়ী হুগলী। সে আমাকে বলিল, ‘আমার বাপের বাড়ী যাইবে?’ আমি রাজি হইলাম। সে আমাকে একদিন সঙ্গে করিয়া গোপাল বাবুর বাড়ীতে লইয়া আসিল। কিন্তু তাহার বাপের বাড়ী আমাকে পাঠাইবার সময় আপনি আমার সঙ্গে আসিল না। তাহার ভাই হীরালালকে আমার সঙ্গে দিল। হীরালালও নৌকা করিয়া আমায় হুগলী লইয়া চলিল |”

আমি এইখানে বুঝিতে পারিলাম যে, রজনী হীরালাল সম্বন্ধে কথা গোপন করিতেছে। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি তাহার সঙ্গে গেলে?”

রজনী বলিল, “ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু যাইতে হইল। কেন যাইতে হইল, তাহা বলিতে পারিব না। পথিমধ্যে হীরালাল আমার উপর অত্যাচার করিতে লাগিল। আমি তাহার বাধ্য নহি দেখিয়া, সে আমাকে বিনাশ করিবার জন্য, গঙ্গার এক চরে নামাইয়া দিয়া নৌকা লইয়া চলিয়া গেল |”

রজনী চুপ করিল-আমি হীরালালকে ছদ্মবেশী রাক্ষস মনে করিয়া, মনে মনে তাহার রূপ ধ্যান করিতে লাগিলাম।-তার পর রজনী বলিতে লাগিল, “সে চলিয়া গেলে, আমি ডুবিয়া মরিব বলিয়া জলে ডুবিলাম |”

আমি বলিলাম, “কেন? তুমি কি হীরালালকে এত ভালবাসিতে?”

রজনী ভ্রূকুটী করিল। বলিল, “তিলার্ধ না। আমি পৃথিবীতে কাহারও উপর এত বিরক্ত নহি |”

“তবে ডুবিয়া মরিতে গেলে কেন?”

“আমার যে দু:খ, তাহা আপনাকে বলিতে পারি না |”

“আচ্ছা। বলিয়া যাও |”

“আমি জলে ডুবিয়া ভাসিয়া উঠিলাম। একখানা গহনার নৌকা যাইতেছিল। সেই নৌকার লোক আমাকে ভাসিতে দেখিয়া উঠাইল। যে গ্রামে আপনার সহিত সাক্ষাৎ, সেইখানে একজন আরোহী নামিল। সে নামিবার সময়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘তুমি কোথায় নামিবে?’ আমি বলিলাম, ‘আমাকে যেখানে নামাইয়া দিবে, আমি সেইখানে নামিব |’ তখন সে জিজ্ঞাসা করিল, ‘তোমার বাড়ী কোথায়?’ আমি বলিলাম, ‘কলিকাতায় |’ সে বলিল, ‘আমি কালি আবার কলিকাতায় যাইব। তুমি আজ আমার সঙ্গে আইস। আজি আমার বাড়ী থাকিবে। কালি তোমাকে কলিকাতায় রাখিয়া আসিব |’ আমি আনন্দিত হইয়া তাহার সঙ্গে উঠিলাম। সে আমাকে সঙ্গে লইয়া চলিল। তার পর আপনি সব জানেন |”

আমি বলিলাম, “আমি যাহার হাত হইতে তোমাকে মুক্ত করিয়াছিলাম, সে কি সেই?”

“সে সেই।”