বিষবৃক্ষ
পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ : খোশ্ খবর
বেলা দুই প্রহর। শ্রীশ বাবু আপিসে বাহির হইয়াছেন। বাটীর লোক জন সব আহারান্তে নিদ্রা যাইতেছে। বৈঠকখানার চাবি বন্ধ। একটা দোআঁসলা গোছ টেরিয়র বৈঠকখানার বাহিরে, পাপোসের উপর, পায়ের ভিতর মাথা রাখিয়া ঘুমাইতেছে। অবকাশ পাইয়া কোন প্রেমময়ী চাকরাণী কোন রসিক চাকরের নিকট বসিয়া গোপনে তামাকু খাইতেছে, আর ফিস ফিস করিয়া বকিতেছে। কমলমণি শয্যাগৃহে বসিয়া পা ছড়াইয়া সূচী-হস্তে কার্পেট তুলিতেছেন–কেশ বেশ একটু একটু আলু থালু–কোথায় কেহ নাই, কেবল কাছে সতীশ বাবু বসিয়া মুখে অনেক প্রকার শব্দ করিতেছেন, এবং বুকে লাল ফেলিতেছেন। সতীশ বাবু প্রথমে মাতার নিকট হইতে উলগুলি অপহরণ করিবার যত্ন করিয়াছিলেন, কিন্তু পাহারা বড় কড়াকড় দেখিয়া, একটা মৃন্ময় ব্যাঘ্রের মুণ্ডলেহনে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। দূরে একটা বিড়াল, থাবা পাতিয়া বসিয়া, উভয়কে পর্যবেক্ষণ করিতেছিল। তাহার ভাব অতি গম্ভীর; মুখে বিশেষ বিজ্ঞতার লক্ষণ; এবং চিত্ত চাঞ্চল্যশূন্য। বোধ হয় বিড়াল ভাবিতেছিল, “মানুষের দশা অতি ভয়ানক, সর্বদা কার্পেটতোলা, পুতুল-খেলা প্রভৃতি তুচ্ছ কাজে ইহাদের মন নিবিষ্ট, ধর্ম-কর্মে মতি নাই, বিড়ালজাতির আহার যোগাইবার মন নাই, অতএব ইহার পরকালে কি হইবে?” অন্যত্র একটা টিকটিকি প্রাচীরাবলম্বন করিয়া ঊর্ধ্বমুখে একটি মক্ষিকার প্রতি দৃষ্টিপাত করিতেছিল। সেও মক্ষিকাজাতির দুশ্চিত্রের কথা মনে মনে আন্দোলন করিতেছিল, সন্দেহ নাই। একটি প্রজাপতি উড়িয়া বেড়াইতেছিল, সতীশ বাবু যেখানে বসিয়া সন্দেশ ভোজন করিয়াছিলেন, ঝাঁকে ঝাঁকে সেখানে মাছি বসিতেছিল–পিপীলিকারাও সার দিতে আরম্ভ করিয়াছিল।
ক্ষণকাল পরে, টিকটিকি মক্ষিকাকে হস্তগত করিতে না পারিয়া অন্য দিকে সরিয়া গেল। বিড়ালও মনুষ্যচরিত্র পরিবর্তনের কোন লক্ষণ সম্প্রতি উপস্থিত না দেখিয়া, হাই তুলিয়া, ধীরে ধীরে অন্যত্র চলিয়া গেল। প্রজাপতি উড়িয়া বাহির হইয়া গেল। কমলমণিও বিরক্ত হইয়া কার্পেট রাখিলেন এবং সতু বাবুর সঙ্গে আলাপে প্রবৃত্ত হইলেন।
কমলমণি বলিলেন, “অ, সতু বাবু, মানুষে আপিসে যায় কেন বলিতে পার?” সতু বাবু বলিলেন, “ইলি–লি–ব্লি |”
ক। সতু বাবু, কখনও আপিসে যেও না।
সতু বলিল, “হাম্!”
কমলমণি বলিলেন, “তোমার হাম্ করার ভাবনা কি? তোমার হাম্ করার জন্য আপিসে যেতে হবে না। আপিসে যেও না–আপিসে গেলে বৌ দুপুরবেলা বসে বসে কাঁদবে |”
সতু বাবু বৌ কথাটা বুঝিলেন : কেন না, কমলমণি সর্বদা তাঁহাকে ভয় দেখাইতেন যে, বৌ আসিয়া মারিবে। সতু বাবু এবার উত্তর করিলেন, “বৌ-মাবে!”
কমল বলিলেন, “মনে থাকে যেন। আপিসে গেলে বৌ মারিবে |”
এইরূপ কথোপকথন কতক্ষণ চলিতে পারিত, তাহা বলা যায় না; কেন না, এই সময়ে একজন দাসী ঘুমে চোখ মুছিতে মুছিতে আসিয়া একখানি পত্র আনিয়া কমলের হাতে দিল। কমল দেখিলেন, সূর্যমুখীর পত্র। খুলিয়া পড়িলেন। পড়িয়া আবার পড়িলেন। আবার পড়িয়া বিষণ্ণ মনে মৌনী হইয়া বসিলেন। পত্র এইরূপ:-
“প্রিয়তমে! তুমি কলিকাতায় গিয়া পর্যন্ত আমাদের ভুলিয়া গিয়াছ–নহিলে একখানি বই পত্র লিখিলে না কেন? তোমার সংবাদের জন্য আমি সর্বদা ব্যস্ত থাকি, জান না?