বিষবৃক্ষ
দেবেন্দ্র বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “সে কি হীরা?”
হী। আপনি শীঘ্র যান–নহিলে আমি চলিলাম।
দে। সে কি, তাড়াইয়া দিতেছ কেন?
হী। আপনি যান–নহিলে আমি লোক ডাকিব–আপনি কেন আমার সর্বনাশ করিতে আসিয়াছিলেন?
হীরা তখন উন্মাদিনীর ন্যায় বিবশা।
দে। একেই বলে স্ত্রীচরিত্র!
হীরা রাগিল–বলিল, “স্ত্রীচরিত্র? স্ত্রীচরিত্র মন্দ নহে। তোমাদিগের ন্যায় পুরুষের চরিত্রই অতি মন্দ। তোমাদের ধর্মজ্ঞান নাই–পরের ভালমন্দ বোধ নাই-কেবল আপনার সুখ খুঁজিয়া বেড়াও–কেবল কিসে কোন স্ত্রীলোকের সর্বনাশ করিবে, সেই চেষ্টায় ফের। নহিলে কেন তুমি আমার বাড়ীতে বসিলে? আমার সর্বনাশ করিবে, তোমার এ কি অভিপ্রায় ছিল না? তুমি আমাকে কুলটা ভাবিয়াছিলে, নহিলে কোন্ সাহসে বসিবে? কিন্তু আমি কুলটা নহি। আমরা দু:খী লোক, গতর খাটাইয়া খাই–কুলটা হইবার আমাদের অবকাশ নাই–বড়মানুষের বউ হইলে কি হইতাম, বলিতে পারি না |” দেবেন্দ্র ভ্রূভঙ্গি করিলেন। দেখিয়া হীরা প্রীতা হইল। পরে উন্নমিতাননে দেবেন্দ্রের প্রতি স্থিরদৃষ্টি করিয়া কোমলতর স্বরে কহিতে লাগিল, “প্রভু, আমি আপনার রূপগুণ দেখিয়া পাগল হইয়াছি। কিন্তু আমাকে কুলটা বিবেচনা করিবেন না। আমি আপনাকে দেখিলেই সুখী হই। এজন্য আপনি আমার ঘরে বসিতে চাহিলে বারণ করিতে পারি নাই–কিন্তু অবলা স্ত্রীজাতি–আমি বারণ করিতে পারি নাই বলিয়া কি আপনার বসা উচিত হইয়াছে? আপনি মহাপাপিষ্ঠ, এই ছলে ঘরে প্রবেশ করিয়া আমার সর্বনাশ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। এখনি আপনি এখান হইতে যান |”
দেবেন্দ্র আর এক ঢোক পান করিয়া বলিলেন, “ভাল, ভাল! হীরে, তুমি ভাল বক্তৃতা করিয়াছ। আমাদের ব্রাহ্মসমাজে একদিন বক্তৃতা দিবে?”
হীরা এই উপহাসে মর্মপীড়িতা হইয়া, রোষকাতরস্বরে কহিল, “আমি আপনাকে উপহাসের যোগ্য নই–আপনাকে অতি অধম লোকে ভালবাসিলেও, তাহার ভালবাসা লইয়া তামাসা করা ভাল নয়। আমি ধার্মিক নহে, ধর্ম বুঝি না–ধর্মে আমার মন নাই। তবে যে আমি কুলটা নই বলিয়া স্পর্ধা করিলাম, তাহার কারণ এই, আমার মনে মনে প্রতিজ্ঞা আছে, আপনার ভালবাসার লোভে পড়িয়া কলঙ্ক কিনিব না। যদি আপনি আমাকে একটুকুও ভালবাসিতেন, তাহা হইলে আমি এ প্রতিজ্ঞা করিতাম না–আমার ধর্মজ্ঞান নাই, ধর্মে ভক্তি নাই–আমি আপনার ভালবাসার তুলনায় কলঙ্কককে তৃণজ্ঞান করি। কিন্তু আপনি ভালবাসেন না–সেখানে কি সুখের জন্য কলঙ্ক কিনিব? কিসের লোভে আমার গৌরব ছাড়িব? আপনি যুবতী স্ত্রী হাতে পাইলে কখন ছাড়েন না, এজন্য আমার পূজা গ্রহণ করিলেও করিতে পারেন, কিন্তু কালে আমাকে হয়ত ভুলিয়া যাইবেন, নয়ত যদি মনে রাখেন, তবে আমার কথা লইয়া দলবলের কাছে উপহাস করিবেন–এমন স্থানে কেন আমি আপনার বাঁদী হইব? কিন্তু যেদিন আপনি আমাকে ভালবাসিবেন, সেই দিন আপনার দাসী হইয়া চরণসেবা করিব |”
দেবেন্দ্র হীরার মুখে এই তিন প্রকার কথা শুনিলেন। তাহার চিত্তের অবস্থা বুঝিলেন। মনে মনে ভাবিলেন, “আমি তোমাকে চিনিলাম, এখন কলে নাচাইতে পারিব। যেদিন মনে করিব, সেই দিন তোমার দ্বারা কার্যোদ্ধার করিব |” এই ভাবিয়া চলিয়া গেলেন।
দেবেন্দ্র হীরার সম্পূর্ণ পরিচয় পান নাই।