দুর্গেশনন্দিনী
গজপতি, ‘বিদ্যাদিগ্গতজ’ উপাধি করিয়া পান নাই। বুদ্ধিখানা অতি তীক্ষ্ণ। বাল্যকালে চতুষ্পাঠীতে ব্যাকরণ আরম্ভ করিয়াছিলেন, সাড়ে সাত মাসে “সহর্ণে র্ঘঃ” সূত্রটি ব্যাখ্যা শুদ্ধ মুখস্থ হয়। ভট্টাচার্য মহাশয়ের অনুগ্রহে আর দশজনের গোলে হরিবোলে পঞ্চদশ বৎসর পাঠ করিয়া শব্দকাণ্ড শেষ করিলেন। পরে অন্য কাণ্ড আরম্ভ করিবার পূর্বে অধ্যাপক ভাবিলেন, “দেখি দেখি কাণ্ডখানাই কি?” শিষ্যকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বল দেখি বাপু, রাম শব্দের উত্তর অম্ করিলে কি হয়?” ছাত্র অনেক ভাবিয়া উত্তর করিলেন, “রামকান্ত |” অধ্যাপক কহিলেন, “বাপু, তোমার বিদ্যা হইয়াছে; তুমি এক্ষণে গৃহে যাও, তোমার এখানকার পাঠ সাঙ্গ হইয়াছে; আমার আর বিদ্যা নাই যে তোমাকে দান করিব |”
গজপতি অতি সাহঙ্কার-চিত্ত হইয়া কহিলেন, “আমার এক নিবেদন–আমার উপাধি?”
অধ্যাপক কহিলেন, “বাপু, তুমি যে বিদ্যা অর্জন করিয়াছ, তোমার নূতন উপাধি আবশ্যক তুমি ‘বিদ্যাদিগ্গজ’ উপাধি গ্রহণ কর |”
দিগ্গজ হৃষ্টচিত্তে গুরুপদে প্রণাম করিয়া গৃহে চলিলেন।
গৃহে আসিয়া দিগ্গজ পণ্ডিত মনে মনে ভাবিলেন, “ব্যাকরণাদিতে ত কৃতবিদ্যা হইলাম। এক্ষণে কিঞ্চিৎ স্মৃতি পাঠ করা আবশ্যক। শুনিয়াছি, অভিরাম স্বামী বড় পণ্ডিত, তিনি ব্যতীত আমাকে শিক্ষা দেয়, এমন লোক আর নাই, অতএব তাঁহার নিকটে গিয়া কিছু স্মৃতি শিক্ষা করা উচিত |” এই স্থির করিয়া দিগ্গজ দুর্গমধ্যে অধিষ্ঠান করিলেন। অভিরাম স্বামী অনেককে শিক্ষা দিতেন; কাহারও প্রতি বিরক্ত ছিলেন না। দিগ্গজ কিছু শিখুক বা না শিখুক, অভিরাম স্বামী তাহাকে পাঠ দিতেন।
গজপতি ঠাকুর কেবল বৈয়াকরণ আর স্মার্ত নহেন; একটু আলঙ্কারিক, একটু একটু রসিক, ঘৃতভাণ্ড তাহার পরিচয়ের স্থল। তাঁহার রসিকতার আড়ম্বরটা কিছু আশমানির প্রতি গুরুতর হইত; তাহার কিছু গূঢ় তাৎপর্যও ছিল। গজপতি মনে করিতেন; “আমার তুল্য ব্যক্তির ভারতে কেবল লীলা করিতে আসা; এই আমার শ্রীবৃন্দাবন, আশমানি আমার রাধিকা |” আশমানিও রসিকা; মদনমোহন পাইয়া বানর-পোষার সাধ মিটাইয়া লইত। বিমলাও সন্ধান পাইয়া কখনও বানর নাচাইতে যাইতেন। দিগ্গজ মনে করিতেন, “এই আমার চন্দ্রাবলী জুটিয়াছে; না হবে কেন? যে ঘৃতভাণ্ড ঝাড়িয়াছি; ভাগ্যে বিমলা জানে না, ওটি আমার শোনা কথা |”