একাদশ পরিচ্ছেদ : আশমানির দৌত্য

এদিকে বিমলার ইঙ্গিতমত আশমানি গৃহের বাহিরে আসিয়া প্রতীক্ষা করিতেছিল। বিমলা আসিয়া তাহাকে কহিলেন, “আশমানি, তোমার সঙ্গে কোন বিশেষ গোপনীয় কথা আছে |”

আশমানি কহিল, “বেশভূষা দেখিয়া আমিও ভাবিতেছিলাম, আজ কি একটা কাণ্ড |”

বিমলা কহিলেন, “আমি আজ কোন প্রয়োজনে অধিক দূরে যাইব। এ রাত্রে একাকিনী যাইতে পারিব না; তুমি ছাড়া আর কাহাকেও বিশ্বাস করিয়া সঙ্গে লইতে পারিব না; তোমাকে আমার সঙ্গে যাইতে হইবে |”

আশমানি জিজ্ঞাসা করিল, “কোথা যাবে?”

বিমলা কহিলেন, “আশমানি, তুমি ত সেকালে এত কথা জিজ্ঞেস করিতে না?”

আশমানি কিছু অপ্রতিভ হইয়া কহিল, “তবে তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি কতকগুলা কাজ সারিয়া আসি|”

বিমলা কহিলেন, “আর একটা কথা আছে; মনে কর, যদি তোমার সঙ্গে আজ সেকালের কোন লোকের দেখা হয়, তবে কি তোমাকে সে চিনিতে পারিবে?”

আশমানি বিস্মিত হইয়া কহিল, “সে কি?”

বিমলা কহিলেন, “মনে কর, যদি কুমার জগৎসিংহের সহিত দেখা হয়?”

আশমানি অনেক্ষণ নীরব থাকিয়া গদগদ স্বরে কহিল, “এমন দিন কি হবে?”

বিমলাও কহিলেন, “হইতেও পারে |”

আশমানি কহিল, “কুমার চিনিতে পারিবেন বৈ কি |”

বিমলা কহিলেন, “তবে তোমার যাওয়া হইবে না, আর কাহাকে লইয়া যাই–একাও ত যাইতে পারি না |”

আশমানি কহিল, “কুমার দেখিব মনে বড়ই সাধ হইতেছে |”

বিমলা কহিলেন, “মনের সাধ মনে থাক; এখন আমি কি করি?”

বিমলা চিন্তা করিতে লাগিলেন। আশমানি অকস্মাৎ মুখে কাপড় দিয়া হাসিতে লাগিল। বিমলা কহিলেন, “মর্! আপনা আপনি হেসে মরিস কেন?”

আশমানি কহিল, “মনে মনে ভাবিতেছিলাম, বলি আমার সোনার চাঁদ দিগ্গতজকে তোমার সঙ্গে পাঠাইলে কি হয়?”

বিমলা হাসিয়া উল্লাসে কহিলেন, “সেই কথাই ভাল; রসিকরাজকেই সঙ্গে লইব|”

আশমানি বিস্মিত হইয়া কহিল, “সে কি, আমি যে তামাসা করিতেছিলাম!”

বিমলা কহিলেন, “তামাসা না, বোকা বামুনকে আমার অবিশ্বাস নাই। অন্ধের দিন রাত্রি নাই, ও ত কিছুই বুঝিতে পারিবে না, সুতরাং ওকে অবিশ্বাস নাই। তবে বামুন যেতে চাবে না |”

আশমানি হাসিয়া কহিল, “সে ভার আমার; আমি তাহাকে সঙ্গে করিয়া নিয়া আসিতেছি, তুমি ফটকের সম্মুখে একটু অপেক্ষা করিও |”

এই বলিয়া আশমানি হাসিতে হাসিতে দুর্গমধ্যস্থ একটি ক্ষুদ্র কুটীরাভিমুখে চলিল।

অভিরাম স্বামীর শিষ্য গজপতি বিদ্যাদিগ্‌‌গজ ইতিপূর্বেই পাঠক মহাশয়ের নিকট একবার পরিচিত হইয়াছেন। যে হেতুতে বিমলা তাঁহার রসিকরাজ নাম রাখিয়াছিলেন, তাহাও পাঠক মহাশয় অবগত আছেন। সেই মহাপুরুষ এই কুটীরের অধিকারী। দিগ্‌গছজ মহাশয় দৈর্ঘ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ সাত হইবেন, প্রস্থে বড় জোর আধ হাত তিন আঙ্গুল। পা দুইখানি কাঁকাল হইতে মাটি পর্যন্ত মাপিলে চৌদ্দপুয়া চারি হাত হইবেক; প্রস্থে রলা কাষ্ঠের পরিমাণ। বর্ণ দোয়াতের কালি; বোধ হয়, অগ্নি কাষ্ঠভ্রমে পা দুখানি ভক্ষণ করিতে বসিয়াছিলেন, কিছুমাত্র রস না পাইয়া অর্ধেক অঙ্গার করিয়া ফেলিয়া দিয়াছেন। দিগ্‌‌গজ মহাশয় অধিক দৈর্ঘ্যবশত: একটু একটু কুঁজো, অবয়বের মধ্যে নাসিকা প্রবল, শরীরে মাংসাভাব সেইখানেই সংশোধন হইয়াছে। মাথাটি বেহায়া-কামান, কামান চুলগুলি যাহা আছে তাহা ছোট ছোট, আবার হাত দিলে সূচ ফুটে। আর্ক-ফলার ঘটাটা জাঁকাল রকম।