দুর্গেশনন্দিনী
তিলোত্তমার শরীর রোমাঞ্চিত হইল। কিছুই উত্তর করিলেন না।
বিমলা বলিতে লাগিলেন, “অভিরাম ঠাকুরের সঙ্গে আমার কথা হইয়াছিল, ঠাকুরের বিবেচনায় জগৎসিংহের সহিত তোমার বিবাহ হইতে পারে না। তোমার বাপ কোন মতে সম্মত হইবেন না। তাঁহার সাক্ষাতে এ কথা পাড়িলে ঝাঁটা লাথি না খাই ত বিস্তর |”
“তবে কেন”–তিলোত্তমা অধোবদনে, অস্ফুটস্বরে, পৃথিবী পানে চাহিয়া এই দুইটি কথা বলিলেন, “তবে কেন?”
বি। কেন? আমি রাজপুত্রের নিকট স্বীকার করিয়া আসিয়াছিলাম, আজ রাত্রে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া পরিচয় দিব। শুধু পরিচয় পাইলে কি হইবে? এখন ত পরিচয় দিই, তার পর তাঁহার কর্তব্যাকর্তব্য তিনি করিবেন। রাজপুত্র যদি তোমাতে অনুরক্ত হন-
তিলোত্তমা তাঁহাকে আর বলিতে না দিয়া মুখে বস্ত্র দিয়া কহিলেন, “তোমার কথা শুনিয়া লজ্জা করে; তুমি যেখানে ইচ্ছা, সেখানে যাও না কেন, আমার কথা কাহাকে বলিও না, আর আমার কাছে কাহারও কথা বলিও না |”
বিমলা পুনর্বার হাসিয়া কহিলেন, “তবে এ বালিকা-বয়সে এ সমুদ্রে ঝাঁপ দিলে কেন?
তিলোত্তমা কহিলেন, “তুই যা! আমি আর তোর কোন কথা শুনিব না |”
বি। তবে আমি মন্দিরে যাব না।
তি। আমি কি কোথাও যেতে বারণ করেছি? যেখানে ইচ্ছা, সেখানে যাও না।
বিমলা হাসিতে লাগিলেন; কহিলেন, “তবে আমি যাইব না |”
তিলোত্তমা পুনরায় অধোমুখী হইয়া কহিলেন, “যাও।” বিমলা আবার হাসিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে কহিলেন, “আমি চলিলাম; আমি যতক্ষণ না আসি, ততক্ষণ নিদ্রা যাইও না |”
তিলোত্তমাও ঈষৎ হাসিলেন; সে হাসির অর্থ এই যে, “নিদ্রা আসিবে কেন?” বিমলা তাহা বুঝিতে পারিলেন। গমনকালে বিমলা এক হস্ত তিলোত্তমার অংসদেশে ন্যস্ত করিয়া, অপর হস্তে তাঁহার চিবুক গ্রহণ করিলেন; এবং কিয়ৎক্ষণ তাঁহার সরল প্রেমপবিত্র মুখ প্রতি দৃষ্টি করিয়া সস্নেহে চুম্বন করিলেন। তিলোত্তমা দেখিতে পাইলেন, যখন বিমলা চলিয়া যান, তখন তাঁহার চক্ষে এক বিন্দু বারি রহিয়াছে।
কক্ষদ্বারে আশমানি আসিয়া বিমলাকে কহিল, “কর্তা তোমাকে ডাকিতেছেন |”
তিলোত্তমা শুনিতে পাইয়া, কাণে কাণে কহিলেন, “বেশ ত্যাগ করিয়া যাও |”
বিমলা কহিলেন, “ভয় নাই |” বিমলা বীরেন্দ্রসিংহের শয়নকক্ষে গেলেন। তথায় বীরেন্দ্রসিংহ শয়ন করিয়া রহিয়াছেন। এক দাসী পদসেবা, অন্যে ব্যজন করিতেছিল। পালঙ্কের নিকট উপস্থিত হইয়া বিমলা কহিলেন, “আমার প্রতি কি আজ্ঞা?”
বীরেন্দ্রসিংহ মস্তকোত্তোলন করিয়া চমৎকৃত হইলেন, বলিলেন, “বিমলা, তুমি কর্মান্তরে যাইবে না কি?”
বিমলা কহিলেন, “আজ্ঞা। আমার প্রতি কি আজ্ঞা ছিল?”
বী। তিলোত্তমা কেমন আছে? শরীর অসুস্থ ছিল, ভাল হইয়াছে?
বি। ভাল হইয়াছে।
বী। তুমি আমাকে ক্ষণেক ব্যজন কর, আশমানি তিলোত্তমাকে আমার নিকট ডাকিয়া আনুক। ব্যজনকারিণী দাসী ব্যজন রাখিয়া গেল।