বিষবৃক্ষ
তখন সূর্যমুখী হীরা দাসীকে ডাকাইলেন।
হীরার নাম একবার উল্লেখ হইয়াছে। তাহার কিছু বিশেষ পরিচয় আবশ্যক।
নগেন্দ্র এবং তাঁহার পিতার বিশেষ যত্ন ছিল যে, গৃহের পরিচারিকারা বিশেষ সৎস্বভাববিশিষ্টা হয়। এই অভিপ্রায়ে, উভয়েই পর্যাপ্ত বেতনদান স্বীকার করিয়া, একটু ভদ্রঘরের স্ত্রীলোকগণকে দাসীত্বে নিযুক্ত করিতে চেষ্টা পাইতেন। তাঁহাদিগের গৃহে পরিচারিকা সুখে ও সম্মানে থাকিত, সুতরাং অনেক দারিদ্র্যগ্রস্ত ভদ্রলোকের কন্যারা তাঁহাদের দাসীবৃত্তি স্বীকার করিত। এই প্রকার যাহারা ছিল, তাহাদের মধ্যে হীরা প্রধানা। অনেকগুলি পরিচারিকা কায়স্থকন্যা–হীরাও কায়স্থ। নগেন্দ্রের পিতা হীরার মাতামহীকে গ্রামান্তর হইতে আনয়ন করেন। প্রথমে তাহার মাতামহীই পরিচর্যায় নিযুক্ত হইয়াছিল–হীরা তখন বালিকা, মাতামহীর সঙ্গে আসিয়াছিল। পরে হীরা সমর্থা হইলে প্রাচীনা দাসীবৃত্তি ত্যাগ করিয়া আপন সঞ্চিত ধনে একটি সামান্য গৃহ নির্মাণ করিয়া গোবিন্দপুরে বাস করিল– হীরা দত্তগৃহে চাকরী করিতে প্রবৃত্ত হইল।
এক্ষণে হীরার বয়স বিংশতি বৎসর। বয়সে সে প্রায় অন্যান্য দাসীগণ অপেক্ষা কনিষ্ঠা। তাহার বুদ্ধির প্রভাবে এবং চরিত্রগুণে সে দাসীমধ্যে শ্রেষ্ঠা বলিয়া গণিত হইয়াছিল।
হীরা বাল্যবিধবা বলিয়া গোবিন্দপুরে পরিচিতা। কেহ কখন তাহার স্বামীর কোন প্রসঙ্গ শুনে নাই। কিন্তু হীরার চরিত্রেও কেহ কোন কলঙ্ক শুনে নাই। তবে হীরা অত্যন্ত মুখরা, সধবার ন্যায় বেশবিন্যাস করিত, এবং বেশবিন্যাসে বিশেষ প্রীতা ছিল।
হীরা আবার সুন্দরী–উজ্জ্বল শ্যামাঙ্গী, পদ্মপলাশলোচনা। দেখিতে খর্বাকৃতা ; মুখখানি যেন মেঘঢাকা চাঁদ ; চুলগুলি যেন সাপ ফণা ধরিয়া ঝুলিয়া রহিয়াছে। হীরা আড়ালে বসে গান করে ; দাসীতে দাসীতে ঝগড়া বাধাইয়া তামাসা দেখে ; পাচিকাকে অন্ধকারে ভয় দেখায় ; ছেলেদের বিবাহের আবদার করিতে শিখাইয়া দেয় ; কাহাকে নিদ্রিত দেখিলে চূণ কালি দিয়া সং সাজায়।
কিন্তু হীরার অনেক দোষ। তাহা ক্রমে জানা যাইবে। আপাতত: বলিয়া রাখি, হীরা আতর গোলাপ দেখিলেই চুরি করে।
সূর্যমুখী হীরাকে ডাকিয়া কহিলেন, “ঐ বৈষ্ণবীকে চিনিস?”
হী। না। আমি কখন পাড়ার বাহির হই না। -আমি বৈষ্ণবী ভিখারী কিসে চিনিব? ঠাকুরবাড়ীর মাগীদের ডেকে জিজ্ঞাসা কর না। করুণা কি শীতলা জানিতে পারে।
সূ। এ ঠাকুরবাড়ীর বৈষ্ণবীর নয়। এ বৈষ্ণবী কে, তোকে জানতে হবে। এ বৈষ্ণবীই বা কে, আর বাড়ীই বা কোথায়? আর কুন্দের সঙ্গে এত ভাবই বা কেন? এই সকল কথা যদি ঠিক জেনে এসে বলিতে পারিস, তবে তোকে নূতন বারাণসী পরাইয়া সং দেখিতে পাঠাইয়া দিব।
নূতন বারাণসীর কথা শুনিয়া হীরার পাঁচ হাত বুক হইল, জিজ্ঞাসা করিল, “কখন জানিতে যেতে হবে?”
সূ। তোর যখন খুসি। কিন্তু এখনও ওর পাছু পাছু না গেলে ঠিকানা পাবি না।
হী। আচ্ছা।
সূ। কিন্তু দেখিস যেন বৈষ্ণবী কিছু বুঝিতে না পারে। আর কেহ কিছু বুঝিতে না পারে।
এমত সময়ে কমল ফিরিয়া আসিল। সূর্যমুখী তাঁহাকে পরামর্শের কথা সব বলিলেন। শুনিয়া কমল খুসি হইলেন। হীরাকে বলিলেন, “আর পারিস ত মাগীকে দুটো বাবলার কাঁটা ফুটিয়ে দিয়ে আসিস!”
হীরা বলিল, “সব পারিব, কিন্তু শুধু বারাণসী নিব না |”
সূ। কি নিবি?
কমল বলিল, “ও একটি বর চায়। ওর একটি বিয়ে দাও|”
সূ। আচ্ছা, তাই হবে–জামাই বাবুকে মনে ধরে? বল তা হলে কমল সম্বন্ধ করে।
হী। তবে দেখবো। কিন্তু আমার মনের মত ঘরে একটি বর আছে।
সূ। কে লো?
হী। যম।