কপালকুণ্ডলা
কে সে ব্যক্তি, কেন দাঁড়াইয়া, জানিতে নবকুমারের কিছুমাত্র ইচ্ছা ছিল না। তাহার প্রতি চাহিয়াও দেখিলেন না। কেবল কপালকুণ্ডলার প্রতি দৃষ্টি রাখিবার জন্য ব্যস্ত। অতএব পথমুক্তির জন্য আগন্তুকের বক্ষে হস্ত দিয়া তাড়িত করিলেন; কিন্তু তাহাকে সরাইতে পারিলেন না।
নবকুমার কহিলেন, “কে তুমি? দূর হও –আমার পথ ছাড় |”
আগন্তুক কহিল, “কে আমি, তুমি কি চেন না?”
শব্দ সমুদ্রনাদবৎ কর্ণে লাগিল। নবকুমার চাহিয়া দেখিলেন; দেখিলেন, সে পূর্বপরিচিত জটাজুটধারী কাপালিক।
নবকুমার চমকিয়া উঠিলেন; কিন্তু ভীত হইলেন না। সহসা তাহার মুখ প্রফুল্ল হইল–কহিলেন, “কপালকুণ্ডলা কি তোমার সহিত সাক্ষাতে যাইতেছে?”
কাপালিক কহিল, “না |”
জ্বালিতমাত্র আশার প্রদীপ তখনই নির্বাণ হওয়াতে নবকুমারের মুখ পূর্ববৎ মেঘময় অন্ধকারাবিষ্ট হইল। কহিলেন, “তবে তুমি পথ মুক্ত কর |”
কাপালিক কহিল, “পথ মুক্ত করিতেছি, কিন্তু তোমার সহিত আমার কিছু কথা আছে–অগ্রে শ্রবণ কর |”
নবকুমার কহিলেন, “তোমার সহিত আমার কি কথা? তুমি আবার প্রাণনাশের জন্য আসিয়াছ? প্রাণ গ্রহণ কর, আমি এবার কোন ব্যাঘাত করিব না। তুমি এক্ষণে অপেক্ষা কর, আমি আসিতেছি। কেন আমি দেবতুষ্টির জন্য শরীর না দিলাম? এক্ষণে তাহার ফলভোগ করিলাম। যে আমাকে রক্ষা করিয়াছিল, সেই আমাকে নষ্ট করিল। কাপালিক! আমাকে এবার অবিশ্বাস করিও না। আমি এখনই আসিয়া তোমাকে আত্মসমর্পণ করিব |”
কাপালিক কহিল, “আমি তোমার প্রাণবধার্থ আসি নাই। ভবানীর তাহা ইচ্ছা নহে। আমি যাহা করিতে আসিয়াছি, তাহা তোমার অনুমোদিত হইবে। বাটীর ভিতরে চল, আমি যাহা বলি, তাহা শ্রবণ কর |”
নবকুমার কহিলেন, “এক্ষণে নহে। সময়ান্তরে তাহা শ্রবণ করিব, তুমি এখন অপেক্ষা কর; আমার বিশেষ প্রয়োজন আছে–সাধন করিয়া আসিতেছি |”
কাপালিক কহিল, “বৎস! আমি সকলই অবগত আছি; তুমি সেই পাপিষ্ঠার অনুসরণ করিবে; সে যথায় যাইবে, আমি তাহা অবগত আছি। আমি তোমাকে সে স্থানে সমভিব্যাহারে করিয়া লইয়া যাইব। যাহা দেখিতে চাহ, দেখাইব–এক্ষণে আমার কথা শ্রবণ কর। কোন ভয় করিও নাম |” নবকুমার কহিলেন, “আর তোমাকে আমার কোন ভয় নাই। আইস |”
এই বলিয়া নবকুমার কাপালিককে গৃহাভ্যন্তরে লইয়া গিয়া আসন দিলেন এবং স্বয়ংও উপবেশন করিয়া বলিলেন, “বল |”