আমি একটু হাসিলাম। এমন অবস্থায় হাসিটা আপনি আসে। কিন্তু এখন আমার প্রকৃত পরিচয় দিবার সময় হয় নাই। আমি হাসিয়া বলিলাম, “আমায় কেহ ঠকাইতে পারে না। তুমি এইমাত্র আমায় জিজ্ঞাসা করিতেছিলে যে, আমি মানুষী কি মায়াবিনী। আমি মানুষী নহি, (তিনি শুনিয়া শিহরিয়া উঠিলেন) আমি কি, তাহা পরে বলিব। এখন ইহাই বলিব যে, আমাকে কেহ ঠকাইতে পারে না।”

স্বামী মহাশয় স্তম্ভিত হইলেন। তিনি বুদ্ধিমান কর্মঠ লোক। নহিলে এত অল্পদিনে এত টাকা রোজগার করিতে পারিতেন না। মানুষটা বাহিরে একটু নীরস—কাঠ কাঠ রকম, পাঠক তাহা বুঝিয়া থাকিবেন—কিন্তু ভিতরে বড় মধুর, বড় কোমল, বড় স্নেহশালী; কিন্তু রমণ বাবুর মত, এখনকার ছেলেদের মত, “উচ্চ শিক্ষায়” শিক্ষিত নহেন। তিনি ঠাকুর দেবতা খুব মানিতেন। নানা দেশে ভ্রমণ করিয়া, ভূত প্রেত, ডাকিনী যোগিনী, যোগী মায়াবিনী প্রভৃতির গল্প শুনিয়াছিলেন। সেসকল একটু বিশ্বাস করিতেন। তিনি আমার দ্বারা যেরূপ মুগ্ধ হইয়াছিলেন, তাহাও তাঁহার এই সময়ে স্মরণ হইল। অতএব আমি যে বলিলাম, আমি মানুষী নহি, তাহাতে তাঁহার একটু বিশ্বাস হইল। তিনি কিছু কাল স্তম্ভিত ও ভীত হইয়া রহিলেন। কিন্তু তার পর নিজ বুদ্ধিবলে, সে বিশ্বাসটুকু দূর করিয়া বলিলেন, “আচ্ছা, তুমি কেমন মায়াবিনী, আমি যা জিজ্ঞাসা করি, বল দেখি?”

আমি। জিজ্ঞাসা কর।

তিনি। আমার স্ত্রীর নাম ইন্দিরা, জান। তার বাপের নাম কি?

আমি। হরমোহন দত্ত।

তিনি। তাঁর বাড়ী কোথায়?

আমি। মহেশপুর।

তিনি। তুমি কে!!!

আমি। তা ত বলিয়াছি যে, পরে বলিব। মানুষ নই।

তিনি। তুমি বলিয়াছিলে, তোমার বাপের বাড়ী কালাদীঘি। কালাদীঘির লোক, এসকল জানিলে জানিতে পারে। এইবার বল—হরমোহন দত্তের বাড়ীর সদর দরওয়াজা কোন্ মুখ?

আমি। দক্ষিণমুখ। একটা বড় ফটকে দুই পাশে দুইটা সিংহী।

তিনি। তাঁর কয় ছেলে?

আমি। এক।

তিনি। নাম কি?

আমি। বসন্তকুমার।

তিনি। তার কয় ভগিনী?

আমি। আপনার বিবাহের সময় দুইটি ছিল।

তিনি। নাম কি?

আমি। ইন্দিরা আর কামিনী।

তিনি। তাঁর বাড়ীর নিকট কোন পুকুর আছে?

আমি। আছে। নাম দেবীদীঘি। তাতে খুব পদ্ম ফুটে।

তিনি। হাঁ, তা দেখিয়াছিলাম। তুমি কখন মহেশপুরে ছিলে? তার বিচিত্র কি? তাই এত জান। আর গোটাকতক কথা বল দেখি। ইন্দিরার বিবাহের সম্প্রদান কোথায় হয়?

আমি। পূজার দালানের উত্তরপশ্চিম কোণে।