জীবানন্দ বলিল, “আমি কত লোক মারিয়া ফেলিয়াছি, তা তুই জানিস?”

এইবার নিমি রাগ করিল, বলিল, “বড় কীর্তিই করেছ – স্ত্রী ত্যাগ করবে, লোক মারবে, আমি তোমায় ভয় করব! তুমিও যে বাপের সন্তান, আমিও সেই বাপের সন্তান – লোক মারা যদি বড়াইয়ের কথা হয়, আমায় মেরে বড়াই কর |”

জীবানন্দ হাসিল, “ডেকে নিয়ে আয় – কোন্ পাপিষ্ঠাকে ডেকে নিয়ে আসবি নিয়ে আয়, কিন্তু দেখ, ফের যদি এমন কথা বলবি, তোকে কিছু বলি না বলি, সেই শালার ভাই শালাকে মাথা মুড়াইয়া দিয়া ঘোল ঢেলে উল্টা গাধায় চড়িয়ে দেশের বার করে দিব |”

নিমি মনে মনে বলিল, “আমিও তা হলে বাঁচি।” এই বলিয়া হাসিতে হাসিতে নিমি বাহির হইয়া গেল, নিকটবর্তী এক পর্ণকুটীরে গিয়া প্রবেশ করিল। কুটীরমধ্যে শতগ্রন্থিযুক্ত বসনপরিধানা রুক্ষকেশা এক স্ত্রীলোক বসিয়া চরকা কাটিতেছিল। নিমাই গিয়া বলিল, “বউ শিগ‍‍গির, শিগগির!” বউ বলিল, “শিগগির কি লো! ঠাকুরজামাই তোকে মেরেছে নাকি, ঘায়ে তেল মাখিয়ে দিতে হবে?”

নি। কাছাকাছি বটে, তেল আছে ঘরে?

সে স্ত্রীলোক তৈলের ভাণ্ড বাহির করিয়া দিল। নিমাই ভাণ্ড হইতে তাড়াতাড়ি অঞ্জলি অঞ্জলি তৈল লইয়া সেই স্ত্রীলোকের মাথায় মাখিয়া দিল। তাড়াতাড়ি একটা চলনসই খোঁপা বাঁধিয়া দিল। তার পর তাহাকে কীল মারিয়া বলিল, “তোর সেই ঢাকাই কোথা আছে বল |” সে স্ত্রীলোক কিছু বিস্মিতা হইয়া বলিল, “কি লো, তুই কি খেপেছিস না কি?”

নিমাই দুম করিয়া তাহার পিঠে এক কীল মারিল, বলিল, “সাড়ী বের কর |”

রঙ্গ দেখিবার জন্য সে স্ত্রীলোক সাড়ীখানি বাহির করিল। রঙ্গ দেখিবার জন্য, কেন না, এত দু:খেও রঙ্গ দেখিবার যে বৃত্তি, তাহা তাহার হৃদয়ে লুপ্ত হয় নাই। নবীন যৌবন; ফুল্লকমলতুল্য তাহার নববয়সের সৌন্দর্য ; তৈল নাই, -বেশ নাই – আহার নাই – তবু সেই প্রদীপ্ত, অননুমেয় সৌন্দর্য সেই শতগ্রন্থিযুক্ত বসনমধ্যেও প্রস্ফুটিত। বর্ণে ছায়ালোকের চাঞ্চল্য, নয়নে কটাক্ষ, অধরে হাসি, হৃদয়ে ধৈর্য। আহার নাই – তবু শরীর লাবণ্যময়, বেশভূষা নাই, তবু সে সৌন্দর্য সম্পূর্ণ অভিব্যক্ত। যেমন মেঘমধ্যে বিদ্যুৎ, যেমন মনোমধ্যে প্রতিভা, যেমন জগতের শব্দমধ্যে সঙ্গীত, যেমন মরণের ভিতর সুখ, তেমনি সে রূপরাশিতে

অনির্বচনীয় কি ছিল! অনির্বচনীয় মাধুর্য, অনির্বচনীয় উন্নতভাব, অনির্বচনীয় প্রেম, অনির্বচনীয় ভক্তি। সে হাসিতে হাসিতে (কেহ সে হাসি দেখিল না), হাসিতে হাসিতে সেই ঢাকাই সাড়ী বাহির করিয়া দিল। বলিল, “কি লো নিমি, কি হইবে?” নিমাই বলিল, “তুই পরবি |” সে বলিল, “আমি পরিলে কি হইবে?” তখন নিমাই তাহার কমনীয় কণ্ঠে আপনার কমনীয় বাহু বেষ্টন করিয়া বলিল, “দাদা এসেছে, তোকে যেতে বলেছে |” সে বলিল, “আমায় যেতে বলেছেন! ত ঢাকাই সাড়ী কেন? চল না এমনি যাই |” নিমাই তার গালে এক চড় মারিল – সে নিমাইয়ের কাঁধে হাত দিয়া তাহাকে কুটীরের বাহির করিল। বলিল, “চল, এই ন্যাক‍ড়া পরিয়া তাঁহাকে দেখিয়া আসি।” কিছুতেই কাপড় বদলাইল না, অগত্যা নিমাই রাজি হইল। নিমাই তাহাকে সঙ্গে লইয়া আপনার বাড়ীর দ্বার পর্যন্ত গেল, গিয়া তাহাকে ভিতরে প্রবেশ করাইয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া আপনি দ্বারে দাঁড়াইয়া রহিল।