আনন্দমঠ
নিমি বলিল, “মন্বন্তর আসবে না কেন, বড় মন্বন্তর, তা আমরা দুটি মানুষ, ঘরে যা আছে, লোককে দিই থুই ও আপনারা খাই। আমাদের গাঁয়ে বৃষ্টি হইয়াছিল, মনে নাই? – তুমি যে সেই বলিয়া গেলে, বনে বৃষ্টি হয়। তা আমাদের গাঁয়ে কিছু ধান হয়েছিল – আর সবাই সহরে বেচে এল – আমরা বেচি নাই |”
জীবানন্দ বলিল, “বোনাই কোথা?”
নিমি ঘাড় হেঁট করিয়া চুপি চুপি বলিল, “সের দুই তিন চাল লইয়া কোথায় বেরিয়েছেন। কে নাকি চাল চেয়েছে |”
এখন জীবানন্দর অদৃষ্টে এরূপ আহার অনেক কাল হয় নাই। জীবানন্দ আর বৃথা বাক্যব্যয়ে সময় নষ্ট না করিয়া গপ্ গপ্ টপ্ টপ্ সপ্ সপ্ প্রভৃতি নানাবিধ শব্দ করিয়া অল্পকালমধ্যে অন্নব্যঞ্জনাদি শেষ করিলেন। এখন শ্রীমতী নিমাইমণি শুধু আপনার ও স্বামীর জন্যা রাঁধিয়াছিলেন, আপনার ভাতগুলি দাদাকে দিয়াছিলেন, পাথর শূন্য দেখিয়া অপ্রতিভ হইয়া স্বামীর অন্নব্যঞ্জনগুলি আনিয়া ঢালিয়া দিলেন। জীবানন্দ ভ্রূক্ষেপ না করিয়া সে সকলই উদরনামক বৃহৎ গর্তে প্রেরণ করিলেন। তখন নিমাইমণি বলিল, “দাদা, আর কিছু খাবে?”
জীবানন্দ বলিল, “আর কি আছে?”
নিমাইমণি বলিল, “একটা পাকা কাঁটাল আছে |”
নিমাই সে পাকা কাঁটাল আনিয়া দিল – বিশেষ কোন আপত্তি না করিয়া জীবানন্দ গোস্বামী কাঁটালটিকেও সেই ধ্বংসপুরে পাঠাইলেন। তখন নিমাই হাসিয়া বলিল, “দাদা আর কিছু নাই |”
দাদা বলিলেন, “তবে যা। আর একদিন আসিয়া খাইব |”
অগত্যা নিমাই জীবানন্দকে আঁচাইবার জল দিল। জল দিতে দিতে নিমাই বলিল, “দাদা, আমার একটি কথা রাখিবে?”
জী। কি?
নি। আমার মাথা খাও।
জী। কি বল না, পোড়ারমুখি।
নি। কথা রাখবে?
জী। কি আগে বল না।
নি। আমার মাথা খাও – পায়ে পড়ি।
জী। তোর মাথাও খাই – তুই পায়েও পড়, কিন্তু কি বল?
নিমাই তখন এক হাতে আর এক হাতের আঙুলগুলি টিপিয়া, ঘাড় হেঁট করিয়া, সেইগুলি নিরীক্ষণ করিয়া, একবার জীবানন্দের মুখপানে চাহিয়া, একবার মাটিপানে চাহিয়া শেষ মুখ ফুটিয়া বলিল, “একবার বউকে ডাকব?”
জীবানন্দ আঁচাইবার গাড়ু তুলিয়া নিমির মাথায় মারিতে উদ্যত; বলিলেন, “আমার মেয়ে ফিরিয়ে দে, আর আমি একদিন তোর চালদাল ফিরিয়া দিয়া যাইব। তুই বাঁদরী, তুই পোড়ারমুখী, তুই যা না বলবার, তাই আমাকে বলিস |”
নিমাই বলিল, “তা হউক, আমি বাঁদরী, আমি পোড়ারমুখী। একবার বউকে ডাকব?”
জী। “আমি চললুম।
এই বলিয়া জীবানন্দ হন হন করিয়া বাহির হইয়া যায়, -নিমাই গিয়া দ্বারে দাঁড়াইল, দ্বারের কবাট রুদ্ধ করিয়া, দ্বারে পিঠ দিয়া বলিল, “আগে আমায় মেরে ফেল, তবে তুমি যাও। বউয়ের সঙ্গে না দেখা করে তুমি যেতে পারবে না |”