রাজসিংহ
বেশভূষা পরিত্যাগ করিয়া নির্মলকুমারী ভাল মানুষ হইয়া বসিলে বাদশাহ তাহাকে তলব করিলেন। নির্মল হাজির হইলে বাদশাহ বলিলেন, “আমরা তাম্বু ভাঙ্গিতেছি–লড়াইয়ে যাইব–তুমি কি এখন উদয়পুর যাইতে চাও?”
নি। না, এক্ষণে আমি ফৌজের সঙ্গে যাইব। যাইতে যাইতে যেখানে সুবিধা বুঝিব, সেইখান হইতে চলিয়া যাইব।
ঔরঙ্গজেব একটু দু:খিতভাবে বলিলেন, “কেন যাইবে?”
নির্মল বলিল, “শাহানশাহের হুকুম |”
ঔরঙ্গজেব প্রফুল্লভাবে বলিলেন, “আমি যদি যাইতে না দিই, তুমি কি চিরদিন আমার রঙমহালে থাকিতে সম্মত হইবে?”
নির্মলকুমারী যুক্তকরে বলিল, “আমার স্বামী আছেন |”
ঔরঙ্গজেব একটু ইতস্তত: করিয়া বলিলেন, “যদি তুমি ইস্লাম ধর্ম গ্রহণ কর–যদি সে স্বামী ত্যাগ কর–তবে উদিপুরী অপেক্ষা তোমাকে গৌরবে রাখিব |”
নির্মল একটু হাসিয়া, অথচ সসম্ভ্রমে বলিল, “তাহা হইবে না, জাঁহাপনা!”
ঔ। কেন হইবে না? কত রাজপুতরাজকন্যা ত মোগলের ঘরে আসিয়াছে।
নি। তাহারা কেহ স্বামী ত্যাগ করিয়া আসে নাই।
ঔ। যদি তোমার স্বামী না থাকিত, তাহা হইলে আসিতে?
নি। এ কথা কেন?
ঔ। কেন, তাহা বলিতে আমার লজ্জা করে, আমি তেমন কথা কখনও কাহাকেও বলি না। আমি প্রাচীন হইয়াছি, কিন্তু কখন কাহাকেও ভালবাসি নাই। এ জন্মে কেবল তোমাকেই ভালবাসিয়াছি। তাই, তুমি যদি বল যে, তোমার স্বামী না থাকিলে তুমি আমার বেগম হইতে, তাহা হইলে এ স্নেহশূন্য হৃদয়–পোড়া পাহাড়ের মত হৃদয়–একটু স্নিগ্ধ হয়।
নির্মল ঔরঙ্গজেবের কথায় বিশ্বাস করিল–কেন না, ঔরঙ্গজেবের কন্ঠের স্বর বিশ্বাসের যোগ্য বলিয়া বোধ হইল। নির্মল ঔরঙ্গজেবের জন্য কিছু দু:খিত হইয়া বলিল, “জাঁহাপনা, এ বাঁদী এমন কি কাজ করিয়াছে যে, সে আপনার ভালবাসার যোগ্য হয়?”
ঔ। তাহা বলিতে পারি না। তুমি সুন্দরী বটে, কিন্তু সৌন্দর্যে মুগ্ধ হইবার বয়স আমার আর নাই। আর তুমি সুন্দরী হইলেও উদিপুরী অপেক্ষা নও। বোধ করি, আমি তোমার কাছে ভিন্ন আর কোথাও সত্য কথা কখন পাই নাই, সেইজন্য। বোধ করি, তোমার বুদ্ধি, চতুরতা, আর সাহস দেখিয়া তোমাকেই উপযুক্ত মহিষী বলিয়া বিশ্বাস হইয়াছে। যাই হৌক, আলম্গীর বাদশাহ তোমার ভিন্ন আর কাহারও বশীভূত হয় নাই। আর কাহারও চক্ষুর কটাক্ষে মোহিত হয় নাই।
নি। শাহানশাহ! আমাকে একদা রূপনগরের রাজকন্যা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “তুমি কাহাকে বিবাহ করিতে ইচ্ছা কর?” আমি বলিয়াছিলাম, আলম্গীর বাদশাহকে। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন?” আমি তাঁহাকে বুঝাইলাম যে, আমি বালককালে বাঘ পুষিয়াছিলাম, বাঘকে বশ করাতেই আমার আনন্দ ছিল। বাদশাহকে বশ করিতে পারিলে আমার সেই আনন্দ হইবে। আমার ভাগ্যবশত:ই অবিবাহিত অবস্থায় আপনার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয় নাই। আমি যে দীন-দরিদ্রকে স্বামিত্বে বরণ করিয়াছি, তাহাতেই আমি সুখী। এক্ষণে আমায় বিদায় দিন।