রাজসিংহ
চঞ্চলকুমারী কয়টা কথা কহিয়া যুবতীসুলভ লজ্জাকে বশে আনিয়াছিল। এক্ষণে মুখ তুলিয়া, রাজসিংহের প্রতি চাহিয়া বলিল, “মহারাজ! আপনার রাজধর্ম আপনি জানেন। আমার ধর্মও আমি জানি। আমি জানি যে, যখন আমি আপনার চরণে আত্মসমর্পণ করিয়াছি, তখন আমি ধর্মত: আপনার মহিষী। আপনি গ্রহণ করুন বা না করুন, ধর্মত: আমি আর কাহাকেও বরণ করিতে পারিব না। যখন ধর্মত: আপনি আমার স্বামী, তখন আপনার আজ্ঞা মাত্র শিরোধার্য। আপনি যদি আমাকে রূপনগরে ফিরিয়া যাইতে বলেন, তবে অবশ্য আমি যাইব। সেখানে গেলে পিতা আমাকে পুনর্বার বাদশাহের নিকট পাঠাইতে বাধ্য হইবেন। কেন না, আমাকে রক্ষা করিবার তাঁহার সাধ্য নাই। যদি তাহাই অভিপ্রেত, তাহা হইলে রণক্ষেত্রে যখন আমি বলিয়াছিলাম যে, ‘মহারাজ! আমি দিল্লী যাইব’–তখন কেন যাইতে দিলেন না?”
রাজসিংহ। সে আমার আপনার প্রাণরক্ষার্থ।
চ। তার পর এখন, যে আপনার শরণ হইয়াছে, তাহাকে আবার দিল্লী যাইতে দিবেন কি?
রা। তাও হইতে পারে না। তবে, তুমি এইখানেই থাক।
চ। অতিথিস্বরূপ থাকিব? না দাসী হইয়া? রূপনগরের রাজকন্যা এখানে মহিষী ভিন্ন আর কিছু হইতে পারে না।
রা। তোমার মত লোকমনোমোহিনী সুন্দরী যে রাজার মহিষী, সকলেই তাঁহাকে ভাগ্যবান বলিবে। তুমি এমন অদ্বিতীয়া রূপবতী বলিয়াই তোমাকে মহিষী করিতে আমি সঙ্কুচিত হইতেছি। শুনিয়াছি যে, শাস্ত্রে আছে, রূপবতী ভার্যা শত্রুস্বরূপ–
“ঋণকার পিতা শত্রুর্মাতা চ ব্যভিচারিণী।
ভার্যা রূপবতী শত্রু: পুত্র: শত্রুরপণ্ডিত: ||”
চঞ্চলকুমারী একটু হাসিয়া বলিল, “বালিকার বাচালতা মার্জনা করিবেন–উদয়পুরের রাজমহিষীগণ সকলেই কি কুরূপা?”
রাজসিংহ বলিলেন, “তোমার মত কেহই সুরূপা নহে |”
চঞ্চলকুমারী বলিল, “আমার বিনীত নিবেদন, কথাটা মহিষীদিগের কাছে বলিবেন না। মহারাণা রাজসিংহেরও ভয়ের স্থান থাকিতে পারে |”
রাজসিংহ উচ্চহাস্য করিলেন। চঞ্চলকুমারী এতক্ষণ দাঁড়াইয়া ছিল–এখন চাপিয়া বসিল, মনে মনে বলিল, “আর ইনি আমার কাছে মহারাণা নহেন, ইনি এখন আমার বর |”
আসন গ্রহণ করিয়া চঞ্চলকুমারী বলিল, “মহারাজ! বিনা আজ্ঞায় আমি যে মহারাজের সম্মুখে আসন গ্রহণ করিলাম, সে অপরাধ আপনাকে মার্জনা করিতে হইতেছে–কেন না, আমি আপনার নিকট জ্ঞানলাভের আকাঙ্ক্ষায় বসিলাম–শিষ্যের আসনে অধিকার আছে। মহারাজ! রূপবতী ভার্যা শত্রু কি প্রকারে, তাহা আমি এখনও বুঝিতে পারি নাই |”
রাজসিংহ। তাহা সহজে বুঝান যায়। ভার্যা রূপবতী হইলে, তাহার জন্য বিবাদ বিসংবাদ উপস্থিত হয়। এই দেখ, তুমি এখনও আমার ভার্যা হও নাই, তথাপি তোমার জন্য ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে আমার বিবাদ বাধিয়াছে। আমাদের বংশের মহারাণী পদ্মিনীর কথা শুনিয়াছ ত?
চ। ঋষিবাক্যে আমার বড় শ্রদ্ধা হইল না। সুন্দরী মহিষী না থাকিলে রাজারা কি বিবাদ হইতে মুক্তি পান? আর এ পামরীর জন্য মহারাজ কেন এ কথা তুলেন? আমি সুরূপা হই, কুরূপা হই, আমার জন্য যে বিবাদ বাধিবার, তাহা ত বাধিয়াছে।