ইন্দিরা
এমন সময় সুভাষিণী আসিয়া আমাকে পাকড়াইল—হাসিতে হাসিতে বলিল, “পোড়ারমুখী, ও করেছ কি, মার চুলে কলপ দিয়াছ?”
আমি। হুঁ!
সু। তোমার মুখে আগুন! কি কাণ্ডখানা হয় দেখ!
আমি। তুমি নিশ্চিন্ত থাক।
এমন সময়ে গৃহিণী স্বয়ং আমাকে তলব করিলেন। বলিলেন, “হাঁ গা কুমো! তুমি কি আমার মাথায় কলপ দিয়াছ?”
দেখিলাম, গৃহিণীর মুখখানা বেশ প্রসন্ন। আমি বলিলাম, “অমন কথা কে বল্লে মা!”
গৃ। এই যে সোণার মা বলছে!
আমি। সোণার মার কি? ও কলপ নয় মা, আমার ওষুধ।
গৃ। তা বেশ ওষুধ বাছা। আরসি একখানা আন দেখি।
একখানা আরসি আনিয়া দিলাম। দেখিয়া গৃহিণী বলিলেন, “ও মা, সব চুল কালো হয়ে গেছে। আ:, আবাগের বেটী, লোকে এখনই বলবে কলপ দিয়েছে।”
গৃহিণীর মুখে হাসি ধরে না। সেদিন সন্ধ্যার পর আমার রান্নার সুখ্যাতি করিয়া আমার বেতন বাড়াইয়া দিলেন। আর বলিলেন, “বাছা! কেবল কাচের চুড়ি হাতে দিয়া বেড়াও, দেখিয়া কষ্ট হয়।” এই বলিয়া তিনি নিজের বহুকালপরিত্যক্ত এক জোড়া সোণার বালা আমায় বখশিস করিলেন। লইতে, আমার মাথা কাটা গেল—চোখের জল সামলাইতে পারিলাম না। কাজেই “লইব না” কথাটা বলিবার অবসর পাইলাম না।
একটু অবসর পাইয়া বুড়া বামন ঠাকুরাণী আমাকে ধরিল। বলিল, “ভাই, আর সে ওষুধ নেই কি?”
আমি। কোন্ ওষুধ? বামনীকে তার স্বামী বশ করবার জন্যে যা দিয়েছিলেন?
বা। দূর হ! একেই বলে ছেলে বুদ্ধি। আমার কি সে সামগ্রী আছে?
আমি। নেই? সে কি গো? একটাও না?
বা। তোদের বুঝি পাঁচটা করে থাকে?
আমি। তা নইলে আর অমন রাঁধি? দ্রৌপদী না হলে ভাল রাঁধা যায়! গোটা পাঁচেক যোটাও না, রান্না খেয়ে লোকে অজ্ঞান হবে।
বামনী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। বলিল, “একটাই যোটে না ভাই—তার আবার পাঁচটা! মুসলমানের হয়, যত দোষ হিন্দুর মেয়ের। আর হবেই বা কিসে? এই ত শোণের নুড়ী চুল! তাই বলছিলাম, বলি সে ওষুধটা আর আছে, যাতে চুল কালো হয়?”
আমি। তাই বল! আছে বৈ কি।
আমি তখন কলপের শিশি বামন ঠাকুরাণীকে দিয়া গেলাম। ব্রাহ্মণ ঠাকুরাণী, রাত্রিতে জলযোগান্তে শয়নকালে, অন্ধাকারে, তাহা চুলে মাখাইয়াছিলেন; কতক চুলে লাগিয়াছিল, কতক চুলে লাগে নাই, কতক বা মুখেচোখে লাগিয়াছিল। সকালবেলা যখন তিনি দর্শন দিলেন, তখন চুলগুলা পাঁচরঙ্গা বেড়ালের লোমের মত, কিছু সাদা, কিছু রাঙ্গা, কিছু কালো; আর মুখখানি কতক মুখপোড়া বাঁদরের মত, কতক মেনিবেড়ালের মত। দেখিবামাত্র পৌরবর্গ উচ্চৈ:স্বরে হাসিয়া উঠিল। সে হাসি আর থামে না। যে যখন পাচিকাকে দেখে, সে তখনই হাসিয়া উঠে। হারাণী হাসিতে হাসিতে বেদম হইয়া সুভাষিণীর পায়ে আছড়াইয়া পড়িয়া, হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, “বৌঠাকুরাণী, আমাকে জবাব দাও, আমি এমন হাসির বাড়ীতে থাকিতে পারিব না—কোন্ দিন দম বন্ধ হইয়া মরিয়া যাইব।”