ইন্দিরা
নবম পরিচ্ছেদ : পাকাচুলের সুখ দু:খ
আমি আশ্রয় পাইলাম। আর একটি অমূল্য রত্ন পাইলাম—একটি হিতৈষিণী সখী। দেখিতে লাগিলাম যে, সুভাষিণী আমাকে আন্তরিক ভালবাসিতে লাগিল--আপনার ভগিনীর সঙ্গে যেমন ব্যবহার করিতে হয়, আমার সঙ্গে তেমনই ব্যবহার করিত। তাঁর শাসনে দাস-দাসীরাও আমাকে অমান্য করিত না। এদিকে রান্নাবান্না সম্বন্ধেও সুখ হইল। সেই বুড়ী ব্রাহ্মণ—ঠাকুরাণী,-সোণার মা তিনি বাড়ী গেলেন না। মনে করিলেন, তিনি গেলে আর চাকরিটি পাইবেন না, আমি কায়েমী হইব। তিনি এই ভাবিয়া নানা ছুতা করিয়া বাড়ী গেলেন না। সুভাষিণীর সুপারিসে আমরা দুই জনেই রহিলাম। তিনি শাশুড়ীকে বুঝাইলেন যে, কুমুদিনী ভদ্রলোকের মেয়ে, একা সব রান্না পারিয়া উঠিবে না—আর সোণার মা বুড়া মানুষই বা কোথায় যায়? শাশুড়ী বলিল, “দুইজনকেই কি রাখিতে পারি? এত টাকা যোগায় কে?”
বধূ বলিল, “তা একজনকে রাখিতে গেলে সোণার মাকে রাখিতে হয়। কুমু এত পারবে না।”
গৃহিণী বলিলেন, “না না। সোণার মার রান্না আমার ছেলে খেতে পারে না। তবে দুইজনেই থাক।”
আমার কষ্টনিবারণ জন্য সুভাষিণী এই কৌশলটুকু করিল। গিন্নী তার হাতে কলের পুতুল; কেন না, সে রমণের বৌ—রমণের বৌর কথা ঠেলে কার সাধ্য? তাতে আবার সুভাষিণীর বুদ্ধি যেমন প্রখরা, স্বভাবও তেমনই সুন্দর। এমন বন্ধু পাইয়া, আমার এ দু:খের দিনে একটু সুখ হইল।
আমি মাছমাংস রাঁধি, বা দুই একখানা ভাল ব্যঞ্জন রাঁধি—বাকি সময়টুকু সুভাষিণীর সঙ্গে গল্প করি—তার ছেলে-মেয়ের সঙ্গে গল্প করি; হলো বা স্বয়ং গৃহিণীর সঙ্গে একটু ইয়ারকি করি। কিন্তু শেষ কাজটায় একটা বড় গোলে পড়িয়া গেলাম। গৃহিণীর বিশ্বাস তাঁর বয়স কাঁচা, কেবল অদৃষ্টদোষে গাছকতক চুল পাকিয়াছে, তাহা তুলিয়া দিলেই তিনি আবার যুবতী হইতে পারেন। এই জন্য তিনি লোক পাইলেই এবং অবসর পাইলেই পাকা চুল তুলাইতে বসিতেন। এক দিন আমাকে এই কাজে বেগার ধরিলেন। আমি কিছু ক্ষিপ্রহস্ত, শীঘ্র শীঘ্রই ভাদ্র মাসের উলু ক্ষেত সাফ করিতেছিলাম। দূর হইতে দেখিতে পাইয়া সুভাষিণী আমাকে অঙ্গুলির ইঙ্গিতে ডাকিল। আমি গৃহিণীর কাছ হইতে ছুটি লইয়া বধূর কাছে গেলাম। সুভাষিণী বলিল, “ও কি কাণ্ড! আমার শাশুড়ীকে নেড়া মুড়া করিয়া দিতেছ কেন?”
আমি বলিলাম, “ও পাপ একদিনে চুকানই ভাল।”
সু। তা হলে কি টেঁকতে পারবে? যাবে কোথায়?
আমি। আমার হাত থামে না যে।
সু। মরণ আর কি! দুই একগাছি তুলে চলে আসতে পার না!
আমি। তোমার শাশুড়ী যে ছাড়ে না।
সু। বল গে যে, কই, পাকা চুল ত বেশী দেখিতে পাই না—এই বলে চলে এসো।
আমি হাসিয়া বলিলাম, “এমন দিনেডাকাতি কি করা যায়? লোকে বলবে কি? এ যে আমার কালাদীঘির ডাকাতি।”
সু। কালাদীঘির ডাকাতি কি?
সুভাষিণীর সঙ্গে কথা কহিতে আমি একটু আত্মবিস্মৃত হইতাম—হঠাৎ কালাদীঘির কথা অসাবধানে মুখ দিয়া বাহির হইয়াছিল। কথাটা চাপিয়া গেলাম। বলিলাম, “সে গল্প আর একদিন করিব।”
সু। আমি যা বলিলাম, তা একবার বলিয়াই দেখ না? আমার অনুরোধে।