চতুর্থ পরিচ্ছেদ : মাণিকলাল

অশ্বারোহী পার্বাতের উপর হইতে দেখিল, চারি জনে একজনকে বাঁধিয়া রাখিয়া চলিয়া গেল। আগে কি হইয়াছে, তাহা সে দেখে নাই, তখন সে পৌঁছে নাই। অশ্বারোহী নি:শব্দে লক্ষ্য করিতে লাগিল, উহারা কোন্ পথে যায়। তাহারা যখন নদীর বাঁক ফিরিয়া পার্ববতন্তরালে অদৃশ্য হইল, তখন অশ্বারোহী অশ্ব হইতে নামিল। পরে অশ্বের গায়ে হাত বুলাইয়া বলিল, “বিজয়! এখানে থাকিও–আমি আসিতেছি–কোন শব্দ করিও না |” অশ্ব স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল; তাহার আরোহী পাদচারে অতি দ্রুতবেগে পর্বতত হইতে অবতরণ করিলেন। পর্বলত যে বড় উচ্চ নহে, তাহা পূর্বে ই বলা হইয়াছে।

অশ্বারোহী পদব্রজে মিশ্র ঠাকুরের কাছে আসিয়া তাঁহাকে বন্ধন হইতে মুক্ত করিলেন। মুক্ত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইয়াছে, অল্প কথায় বলুন |” মিশ্র বলিলেন, “চারি জনের সঙ্গে আমি একত্র আসিতেছিলাম। তাহাদের চিনি না–পথের আলাপ; তাহারা বলে ‘আমরা বণিক |’ এইখানে আসিয়া তাহারা মারিয়া ধরিয়া আমার যাহা কিছু ছিল, কাড়িয়া লইয়া গিয়াছে |”

প্রশ্নকর্তাা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি কি লইয়া গিয়াছে?”

ব্রাহ্মণ বলিল, “একগাছি মুক্তার বালা, কয়টি আশরফি, দুইখানি পত্র |”

প্রশ্নকর্তাি বলিলেন, “আপনি এইখানে থাকুন। উহারা কোন্ দিকে গেল, আমি দেখিয়া আসি |”

ব্রাহ্মণ বলিলেন, “আপনি যাইবেন কি প্রকারে? তাহারা চারি জন, আপনি একা |”

আগন্তুক বলিল, “দেখিতেছেন না, আমি রাজপুত সৈনিক |”

অনন্ত মিশ্র দেখিলেন, এই ব্যক্তি যুদ্ধব্যবসায়ী বটে। তাহারা কোমরে তরবারি এবং পিস্তল, এবং হস্তে বর্শা। তিনি ভয়ে আর কথা কহিলেন না।

রাজপুত, যে পথে দস্যুগণকে যাইতে দেখিয়াছিলেন, সেই পথে, অতি সাবধানে তাহাদিগের অনুসরণ করিতে লাগিলেন। কিন্তু বনমধ্যে আসিয়া আর পথ পাইলেন না, অথবা দস্যুদিগের কোন নিদর্শন পাইলেন না।

তখন রাজপুত আবার পর্ব তের শিখরদেশে আরোহণ করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ ইতস্তত: দৃষ্টি করিতে করিতে দেখিলেন যে, দূরে বনের ভিতর প্রচ্ছন্ন থাকিয়া, চারি জনে যাইতেছে। সেইখানে কিছুক্ষণ অবস্থিতি করিয়া দেখিতে লাগিলেন, ইহারা কোথায় যায়। দেখিলেন, কিছু পরে উহারা একটা পাহাড়ের তলদেশে গেল, তাহার পর উহাদের আর দেখা গেল না। তখন রাজপুত সিদ্ধান্ত করিলেন যে, উহারা হয় ঐখানে বসিয়া বিশ্রাম করিতেছে–বৃক্ষাদির জন্য দেখা যাইতেছে না; নয়, ঐ পর্ব ততলে একটি গুহা আছে। গুহামধ্যে মনুষ্যের কথাবার্তা শুনিতে পাইলেন।

এই পর্যতন্ত আসিয়া রাজপুত কিছু ইতস্তত: করিতে লাগিলেন। উহারা চারি জন–তিনি একা; এক্ষণে গুহামধ্যে প্রবেশ করা উচিত কি না? যদি গুহাদ্বার রোধ করিয়া উহারা চারি জনে তাঁহার সঙ্গে সংগ্রাম করে, তবে তাঁহার বাঁচিবার সম্ভাবনা নাই। কিন্তু এ কথা রাজপুতের মনে বড় অধিকক্ষণ স্থান পাইল না–মৃত্যুভয় আবার ভয় কি? মৃত্যুভয়ে রাজপুত কোন কার্যর হইতে বিরত হয় না। কিন্তু দ্বিতীয় কথা এই যে, তিনি গুহামধ্যে প্রবেশ করিলেই তাঁহার হস্তে দুই একজন অবশ্য মরিবে; যদি উহারা সেই দস্যুদল না হয়? তবে নিরপরাধীর হত্যা হইবে।