দেবী বলিল, “আজ্ঞা করুন |”

যোধপুরী বলিলেন, “রূপনগরের রাজকুমারীর সংবাদ শুনিয়াছ। তাঁর কাছে যাইতে হইবে। চিঠি-পত্র দিব না, যাহা বলিবে, আমার নাম করিয়া বলিবে, আর আমার এই পাঞ্জা দেখাইবে, তিনি বিশ্বাস করিবেন। ঘোড়ায় চড়িতে পার, ঘোড়ায় যাইবে। ঘোড়া কিনিবার খরচ দিতেছি |”

দেবী। কি বলিতে হইবে?

বেগম। রাজকুমারীকে বলিবে, হিন্দুর কন্যা হইয়া মুসলমানের ঘরে না আসেন। আমরা আসিয়া, নিত্য মরণ কামনা করিতেছি। বলিবে যে, তসবির ভাঙ্গার কথাটা বাদশাহ শুনিয়াছেন, তাঁকে সাজা দিবার জন্যই আনিতেছেন। প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন, রূপনগরওয়ালীকে দিয়া উদিপুরীর তামাকু সাজাইবেন। বলিও, বরং বিষ খাইও, তথাপি দিল্লীতে আসিও না।

“আরও বলিও, ভয় নাই। দিল্লীর সিংহাসন টলিতেছে। দক্ষিণে মারহাট্টা মোগলের হাড় ভাঙ্গিয়া দিতেছে। রাজপুতেরা একত্রিত হইতেছে। জেজিয়ার জ্বালায় সমস্ত রাজপূতানা জ্বলিয়া উঠিয়াছে। রাজপুতানায় গোহত্যা হইতেছে। কোন্ রাজপুত ইহা সহিবে? সব রাজপুত একত্রিত হইতেছে। উদয়পুরের রাণা, বীরপুরুষ। মোগল তাতারের মধ্যে তাঁর মত কেহ নাই। তিনি যদি রাজপুতগণের অধিনায়ক হইয়া অস্ত্রধারণ করেন–যদি এক দিকে শিবজী, আর এক দিকে রাজসিংহ অস্ত্র ধরেন, তবে দিল্লীর সিংহাসন কয় দিন টিকিবে?”

দেবী। এমন কথা বলিও না, মা! দিল্লীর তক্ত, তোমার ছেলের জন্য আছে। আপনার ছেলের সিংহাসন ভাঙ্গিবার পরামর্শ আপনি দিতেছ?

বেগম। আমি এমন ভরসা করি না যে, আমার ছেলে এ তক্তে বসিবে। যত দিন রাক্ষসী জেব-উন্নিসা আর ডাকিনী উদিপুরী বাঁচিবে, তত দিন সে ভরসা করি না। একবার সে ভরসা করিয়া, রৌশন্বারার কাছে বড় মার খাইয়াছিলাম।2 রৌশন্বারারা যোধপুরীর নাক-মুখ ছিঁড়িয়া দিয়াছিল। আজিও মুখে চোখে সে দাগ-জখমের চিহ্ন আছে।

এইটুকু বলিয়া যোধপুরকুমারী একটু কাঁদিলেন। তার পর বলিলেন, “সে সব কথায় কাজ নাই। তুমি আমার সকল মতলব বুঝিবে না–বুঝিয়াই বা কি হইবে? যাহা বলি, তাই করিও। রাজকুমারীকে রাজসিংহের শরণ লইতে বলিও। প্রত্যাখ্যান করিবেন না। বলিও, আমি আশীর্বারদ করিতেছি যে, তিনি রাণার মহিষী হউন। মহিষী হইলে যেন প্রতিজ্ঞা করেন যে, উদিপুরী তাঁর তামাকু সাজিবে–রৌশন্বারা তাঁকে পাখার বাতাস করিবে।

দেবী। এও কি হয় মা?

বেগম। সে কথার বিচার তুমি করিও না। আমি যা বলিলাম, তা পারিবে কি না?

দেবী। আমি সব পারি।

বেগম তখন দেবীকে প্রয়োজনীয় অর্থ ও পুরস্কার এবং পাঞ্জা দিয়া বিদায় করিলেন।

 

2-কথাটা ঐতিহাসিক।