রাজসিংহ
উদিপুরীর যেমন অতুল্য রূপ, তেমনি অতুল্য মদ্যাসক্তি। দিল্লীর বাদশাহেরা মুসলমান হইয়াও অত্যন্ত মদ্যাসক্ত ছিলেন। তাঁহাদিগের পৌরবর্গ এ বিষয়ে তাঁহাদের দৃষ্টান্তনুগামী হইতেন। রঙমনহালেও এ রঙ্গের ছড়াছড়ি! এই নরকমধ্যেও উদিপুরী নাম জাহির করিয়া তুলিয়াছিল।
জেব-উন্নিসা হঠাৎ উদিপুরীর শয়নগৃহে প্রবেশ করিতে পারিল না। কেন না, ভারতেশ্বরের প্রিয়তমা মদ্যপানে প্রায় বিলুপ্তচেতনা; বসনভূষণ কিছু বিপর্য্যস্ত, বাঁদীরা সজ্জা পুনর্বিন্যস্ত করিল; ডাকিয়া সচেতন ও সাবধান করিয়া দিল। জেব-উন্নিসা আসিয়া দেখিল, উদিপুরীর বাম হাতে সটকায়, নয়ন অর্ধিনিমীলিত, অধরবান্ধুলীর উপর মাছি উড়িতেছে; ঝটিকা বিভিন্ন ভূপতিত বৃষ্টিনিষিক্ত পুষ্পরাশির মত উদিপুরী বিছানায় পড়িয়া আছে।
জেব-উন্নিসা আসিয়া কুর্ণিশ করিয়া বলিল, “মা! আপনার মেজাজ উত্তম ত?”
উদিপুরী অর্ধউজাগতের স্বরে, রসনার জড়তার সহিত বলিল, “এত রাত্রে কেন?”
জে। একটা বড় খবর আছে।
উ। কি? মারহাট্টা ডাকু মরেছে?
জে। তারও অপেক্ষা খোশ খবর।
এই বলিয়া জেব-উন্নিসা গুছাইয়া বাড়াইয়া রঙ ঢালিয়া দিয়া, চঞ্চলকুমারীর সেই তসবির ভাঙ্গার গল্পটা করিলেন। উদিপুরী জিজ্ঞাসা করিল, “এ আর খোশ খবর কি?”
জেব-উন্নিসা বলিল, “এই মহিষের মত বাঁদীগুলা হজরতের তামাকু সাজে, আমি তাহা দেখিতে পারি না। রূপনগরের সেই সুন্দরী রাজকুমারী আসিয়া হজরতের তামাকু সাজিবে, বাদশাহের কাছে এই ভিক্ষা চাহিও |”
উদিপুরী না বুঝিয়া, নেশার ঝোঁকে বলিল, “বহুত আচ্ছা |”
ইহার কিছু পরে রাজকার্যম পরিশ্রমক্লান্ত বাদশাহ শ্রমাপনয়ন জন্য উদিপুরীর মন্দিরে উপস্থিত হইলেন। উদিপুরী নেশার ঝোঁকে চঞ্চলকুমারীর কথা, জেব-উন্নিসার কাছে যেমন শুনিয়াছিল, তেমনই বলিল। “সে আসিয়া আমার তামাকু সাজিবে,” এ প্রার্থনাও জানাইল। বলিবামাত্র ঔরঙ্গজেব শপথ করিয়া স্বীকার করিলেন। কেন না, ক্রোধে অস্থির হইয়াছিলেন।