চতুর্থ পরিচ্ছেদ

এক্ষণে পাঠক মহাশয়ের সহিত যাঁহাদিগের পরিচয় হইল, তাঁহাদিগের পূর্ব্ব বিবরণ কথনে প্রবৃত্ত হই।

পূর্ব্বাঞ্চলে কোন ধনাঢ্য ভূস্বামীর আলয়ে বংশীবদন ঘোষ নামে এক ভৃত্য ছিল। এই ভূস্বামীর বংশ ও নাম এক্ষণে লোপ হইয়াছে, কিন্তু পূর্ব্বে তাঁহার যথেষ্ট খ্যাতি প্রতিপত্তি ছিল। বৃদ্ধকাল পর্য্যন্ত সন্তানের মুখাবলোকন না করিয়া শেষ বয়সে তিনি দ্বিতীয় দার পরিগ্রহ করিলেন। কিন্তু বিধির নির্ব্বন্ধ কে খণ্ডাইতে পারে? দ্বিতীয় পত্নীও সন্তানরত্নপ্রসবিনী হইলেন না। না হউন, বার্দ্ধক্যের তরুণী স্ত্রী একাই এক সহস্র। সত্য বটে মধ্যে মধ্যে দুই সপত্নীতে কিছু গোলযোগ উপস্থিত করিতেন; কখন কখন কর্ত্তার নিকট আসিয়া উভয়ে চীৎকারের মহলা দিতেন; কখন বা কনিষ্ঠা জ্যেষ্ঠার কাপড় টানিয়া ছিঁড়িতেন; জ্যেষ্ঠা কনিষ্ঠার চুল টানিয়া ছিঁড়িতেন। এখনও কখন হইয়াছে যে, ছেঁড়া ছিঁড়ি নাক কাণ পর্য্যন্ত উঠিয়াছে। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হইলেই প্রায় উলু খাক্‌ড়ার প্রাণ বধ হইয়া থাকে,-বৃদ্ধ, সহধর্ম্মিণীদিগের সময়ে সময়ে নিকটে থাকিলেই লাথিটা গুঁতাটায় বঞ্চিত হইতেন না; কনিষ্ঠার পদাঘাত পাইলেই মনে করিতেন,-এইবার পূর্ব্বপুরুষেরা স্বর্গে উঠিলেন; এমনই লাথির জোর। জ্যেষ্ঠা সর্ব্বদা বলিতেন, “বড়র বড়, ছোটর ছোট।” শেষে করাল কাল মধ্যস্থ হইয়া “বড়র বড়, ছোটর ছোট” বলিয়া বড়কে আগে অন্তর্হিত করিল।

বয়োধিকা পত্নীর মৃত্যু দেখিয়া প্রাচীন মনে করিলেন, “ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে; আমাকেও কোন্ দিন ডাক পড়ে এই। মরি তাতে ক্ষতি নাই, বার ভূতে বিষয়টা খাবে।”

প্রেয়সী যুবতীর সাক্ষাতে মনের কথা বলিলে প্রেয়সী বলিলেন, “কেন আমি আছি, আমি কি তোমার বার ভূত?” বৃদ্ধ কর্ত্তা কহিলেন, তুমি যেখানে এক বিঘা জমি স্বহস্তে দান বিক্রয় করিতে পারিবে না, সেখানে তুমি আর বিষয় ভোগ করিলে কি?” চতুরা কহিল, “তুমি মনে করিলে সব পার; বিষয় বিক্রয় করিয়া আমায় নগদ টাকাটা দাও না।” তথাস্তু বলিয়া ভূস্বামী ভূমি বিক্রয় করিয়া অর্থসঞ্চয়ে মন দিলেন। স্ত্রীর আজ্ঞা এমনই ফলবতী যে, যখন বৃদ্ধ লোকান্তরে গমন করিল, তখন তাহার বিপুল সম্পত্তি প্রায় স্বর্ণরৌপ্যরাশিতেই ছিল-ভূমি অতি অল্প ভাগ। করুণাময়ী বড় বুদ্ধিমতী; তিনি মনে মনে ভাবিলেন, “এখন ত সকলই আমার; ধন আছে, জন আছে, যৌবনও আছে। ধন জন যৌবন সকলই বৃথা; যত দিন থাকে তত দিন ভোগ করিতে হয়।”

ভগবান্ শ্রীরামচন্দ্র অবতারে যখন জানকী বিচ্ছেদে কাতর হন, তখন কি করেন, সীতার একটি সুবর্ণ প্রতিমূর্ত্তি গঠন করিয়া মনকে আশ্বাস দিয়াছিলেন। করুণাময়ীও সেইরূপ স্বামীর কোনও প্রতিমূর্ত্তির মুখ নিরীক্ষণ করিয়া এ দুঃসহ বিরহ যন্ত্রণা নিবারণ না করেন কেন? আরও ভাবিলেন, রামচন্দ্র ধাতুময় প্রতিমূর্ত্তিতে হৃদয় স্নিগ্ধ করিতেন; নির্জ্জীব ধাতুতে যদি মনোদুঃখ নিবারণ হয়, তবে যদি একটা সজীব পতিপ্রতিনিধি করি তাহ’লে আরও সুখদ হইবে সন্দেহ কি? কেন না, সজীব প্রতিনিধিতে কেবল যে চক্ষুর তৃপ্তি হইবে এমত নহে, সময়ে সময়ে কার্য্যোদ্ধারও সম্ভাবনা। অতএব একটা উপ-স্বামী স্থির করা আবশ্যক। পতি এমন পরম পদার্থ যে, একেবারে পতিহীন হওয়া অপেক্ষা একটা উপপতি রাখাও ভাল; বিশেষ শ্রীরামচন্দ্র যাহা করিয়াছেন তাহাতে কি আর কিন্তু আছে?

এইরূপ বিবেচনা করিয়া করুণাময়ী স্বামীর সজীব প্রতিমূর্ত্তিত্বে কাহাকে বরণ করিবে ভাবিতে ভাবিতে বংশীবদন ঘোষ খানসামার উপর নজর পড়িল; বংশীবদনকে আর কে পায়? ধর্ম্ম অর্থ কাম মোক্ষ লইয়া সংসার, তাহার মধ্যে ধর্ম্ম আদৌ, কাম মোক্ষ-পশ্চাৎ। এই তিনকে যদি করুণাময়ী ভৃত্যের শ্রীচরণে সমর্পণ করিতে পারিল, রহিল অর্থ। অর্থ আর কয়দিন বাকি থাকে? খানসামা বাবু অতি শীঘ্র সদর নায়েব হইয়া বসিলেন। কালে সকলের লয়,-কালে প্রণয়ের লয়-কালে প্রণয়ীর লয়,-প্রণয়ময়ী অতি শীঘ্রই খানসামাকে ত্যাগ করিয়া প্রেমাপদ মৃত স্বামীর অনুবর্ত্তিনী হইলেন।