তৃতীয় পরিচ্ছেদ

কনকময়ী এবং তৎসঙ্গিনী নীরবে গৃহাভিমুখে চলিলেন। লোকের সম্মুখে কথা কহিতে কনকের সহচরী অতি লজ্জাকর বোধ করিতে লাগিলেন। তাঁহাকে নীরব দেখিয়া কনকও নীরব। কিন্তু এমন লোকালয়মধ্যে রসনারূপিণী প্রচণ্ডা অশ্বিনী যে নিজ প্রাখর্য্যাদি গুণ দেদীপ্যমান করিতে পারিল না, কনকের ইহাতে বড় মনোদুঃখ রহিল। তাঁহারা আপনাপন গৃহ-সান্নিধ্যে আসিলেন; তথায় লোকের গতিবিধি অধিক না থাকায় কনীয়সী কথোপকথন আরম্ভ করিলেন; বলিলেন, “কি পোড়া কপালে বাতাস দিদি, আমাকে কি নাস্তানাবুদই করিল।”

কনক হাসিয়া কহিল, “কেন, তোমার ভগ্নীপতি কি কখন তোমার মুখ দেখে নাই?”

কনীয়সী। আমি ত তাহার জন্য বলিতেছি না-অন্য একজন যে কে ছিল।

কনক। কেন, সে যে, মথুরবাবু; তাহাকে কি কখন দেখ নাই?

কনীয়সী। কবে দেখিলাম-আমার ভগ্নীপতির জ্যেঠাত ভাই মথুরবাবু?

কনক। সে না ত কে?

কনীয়সী। কি লজ্জা বোন্ কাহারও সাক্ষাতে বলিস্ না।

কনক। মরণ আর কি! আমি লোকের কাছে গল্প করিতে যাইতেছি যে, তুমি জল আনিতে ঘোমটা খুলে মুখ দেখাইয়াছিলে।

এই বলিয়া কনক মুখ টিপিয়া হাসিতে লাগিল। তরুণী সরোষে কহিল, “তুমি ভাগাড়ে পড় না কেন? কথার রকম দেখ। এমত জানিলে কি আমি তোমার সঙ্গে আসিতাম?”

কনক পুনরায় হাস্য করিতে লাগিল; যুবতী কহিলেন, “তোর ও হাসি আমার ভাল লাগে না-সর্ব্বনাশ! দুর্গা যা করেন।”

এই বলিয়া নবীনা গৃহাভিমুখে নিরীক্ষণ করিয়া কম্পিতকলেবরা হইল। কনকময়ীও সেই দিকে নিরীক্ষণ করিয়া এই আকস্মিক ভীতির হেতু অনুভূত করিলেন, তাঁহারা প্রায় গৃহ-সান্নিধ্যে উপনীতা হইয়াছিলেন। কনক দেখিতে পাইল যে, দ্বারে অগ্নিবিচ্ছুরিত নয়নে কালমূর্ত্তির ন্যায় রাজমোহন দণ্ডায়মান রহিয়াছে। সঙ্গিনীর কর্ণে কর্ণে সে কহিল,-“আজ দেখিতেছি মহাপ্রলয়; আমি তোর সঙ্গে যাই, যদি অকূলে কাণ্ডারী হইতে পারি।”

রাজমোহনের স্ত্রী তদ্রূপ মৃদুস্বরে কহিল, “না, না, আমারও সহ্য আছে-তুমি থাকিলে হয়ত হিতে বিপরীত হবে তুমি বাড়ী যাও।”

ইহা শুনিয়া কনক পথান্তরে নিজ গৃহে গমন করিল। তাঁহার সহচরী যখন নিজ গৃহে প্রবেশ করিলেন, তখন রাজমোহন কিছুই বলিল না। তাহার স্ত্রী জলকলসী লইয়া পাকশালায় রাখিলেন। রাজমোহন নিঃশব্দে সঙ্গে সঙ্গে পাকশালায় যাইলেন। স্ত্রী কলসীটি রাখিলে রাজমোহন কহিল, “একটু দাঁড়াও।” এই বলিয়া জলের কলসী লইয়া আঁস্তাকুড়ে জল ঢালিয়া ফেলিলেন। রাজমোহনের একটি প্রাচীনা পিসী ছিল। পাকের ভার তাঁরই প্রতি; তিনি এইরূপ জলের অপচয় দেখিয়া রাজমোহনকে ভর্ৎসনা করিয়া কহিলেন, “আবার জলটা অপচয় করিতেছিস্ কেন রে? তোর ক’গণ্ডা দাসী আছে যে, আবার জল আনিয়া দিবে?”

“চুপ কর্ মাগী হারামজাদী” বলিয়া রাজমোহন বারিশূন্য কলসীটা বেগে দূরে নিক্ষেপ করিল; এবং স্ত্রীর দিকে ফিরিয়া অপেক্ষাকৃত মৃদু অথচ অন্তর্জ্বালাকর স্বরে কহিল, “তবে রাজরাণী, কোথায় যাওয়া হইয়াছিল?”