অসম্পূর্ণ রচনা
অভ্যাগতা যে ত্রিংশৎবর্ষবয়স্কা এ কথা পূর্ব্বেই বলিয়াছি। সে শ্যামবর্ণা-কাল নয়-কিন্তু তত শ্যামও নয়। মুখকান্তি নিতান্ত সুন্দর নয়, অথচ কোন অংশ চক্ষুর অপ্রিয়কর নয়; তন্মধ্যে ঈষৎ চঞ্চল মাধুরী ছিল, এবং নয়নের ‘হাসি হাসি’-ভাবে সেই মাধুরী আরও মধুর হইয়াছিল। দেহময় যে অলঙ্কারসকল ছিল, তাহা সংখ্যায় বড় অধিক না হইবে, কিন্তু একটি মুটের বোঝা বটে। যে শঙ্খবণিক সেই বিশাল শঙ্খ নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন, তিনি বিশ্বকর্ম্মার অতিবৃদ্ধ প্রপৌত্র সন্দেহ নাই। আভরণময়ীর স্থূলাঙ্গে একখানি মোটা শাটী ছিল; শাটীখানি বুঝি রজকের উপর রাগ করিয়াছিল, তাই সে পথে অনেক কাল গতিবিধি করে নাই।
অষ্টাদশবর্ষীয়ার কোমল অঙ্গে এতাদৃশ অলঙ্কার বেশী ছিল না। বস্তুতঃ তাহার বাক্যালাপে পূর্ব্ব বঙ্গীয় কোনরূপ কণ্ঠবিকৃতি সংলক্ষিত হইত না; ইহাতে স্পষ্ট অনুভূত হইতে পারে যে, এই সর্ব্বঙ্গসুন্দর রমণীকুসুম মধুমতী-তীরজ নহে-ভাগীরথী-কূলে রাজধানী সন্নিহিত কোনও স্থানে জাতা ও প্রতিপালিতা হইয়া থাকিবেক। তরুণীর আরক্ত গৌরবর্ণছটা মনোদুঃখ বা প্রগাঢ় চিন্তাপ্রভাবে কিঞ্চিৎ মলিন হইয়াছিল; তথাচ যেমন মধ্যাহ্ন রবির কিরণে স্থলপদ্মিনী অর্দ্ধ প্রোজ্জ্বল, অর্দ্ধশুষ্ক হয়, রূপসীর বর্ণজ্যোতি সেইরূপ কমনীয় ছিল। অতিবর্দ্ধিতকেশজাল অযত্নশিথিল গ্রন্থিতে স্কন্ধদেশে বদ্ধ ছিল; তথাপি অলককুন্তল সকল বন্ধন দশায় থাকিতে অসম্মত হইয়া ললাট কপোলাদি ঘিরিয়া বসিয়াছিল। প্রশস্ত পূর্ণায়ত ললাটতলে নির্দ্দোষ বঙ্কিম ভ্রূযুগল ব্রীড়াবিকম্পিত; নয়নপল্লবাবরণে লোচনযুগল সচরাচর অর্দ্ধাং শমাত্র দেখা যাইত; কিন্তু যখন সে পল্লব ঊর্দ্ধোত্থিত হইয়া কটাক্ষ স্ফুরণ করিত, তখন বোধ হইত যেন নৈদাঘ মেঘমধ্যে সৌদামিনী-প্রভা প্রকটিত হইল। কিন্তু সে যৌবনমদমত্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিক্ষেপে চিন্তাকুলতা প্রতীত হইত; এবং তথায় ক্ষুদ্র ওষ্ঠাধর দেখিলেই বুঝা যাইত, সে হৃদয়তলে কত সুখ দুঃখ বিরাজ করিতেছে। তাহার অঙ্গসৌষ্ঠ ও নির্ম্মাণ-পারিপাট্য, শারীরিক বা মানসিক ক্লেশে অনেক নষ্ট হইয়াছিল; তথাচ পরিধেয় পরিষ্কার শাটীখণ্ডমধ্যে যাহা অর্দ্ধ দৃষ্ট হইতেছিল, তাহার অনুরূপ শিল্পকর কখনও গড়ে নাই। সেই সুঠাম অঙ্গ প্রায় নিরাভরণ, কেবলমাত্র প্রকোষ্ঠে ‘চুড়ি’ ও বাহুতে ‘মুড়কিমাদুলি’ ইহাও বড় সুগঠন।
তরুণী হস্তস্থিত সুচ্যাদি একপার্শ্বে রাখিয়া অভ্যাগতার সহিত বাক্যালাপে প্রবৃত্ত হইলেন। অভ্যাগতা কথোপকথনকালে নিজ গৃহযন্ত্রণা-বর্ণনে বিস্তর সদ্বক্তৃত্ব প্রকাশ করিলেন; দোষের মধ্যে এই, যে যন্ত্রণাগুলিন বর্ণনা করিলেন, তাহা প্রায় কাল্পনিক। বক্ত্রী নিজ কর্দ্দমময় বস্ত্রাঞ্চলের অগ্রভাগ লইয়া পুনঃ পুনঃ চক্ষে দিতে লাগিলেন; বিধাতা তাঁহাকে যে চক্ষুযুগল দিয়াছিলেন সে কিছু এমত অবস্থার যোগ্য নয়; কিন্তু কি হবে?-অবস্থাবিশেষে শালগ্রামেরও মৃত্যু ঘটে। চক্ষুর ঘটে নাই, যতবার কাপড়খানা এসে ঠেকে ততবার চক্ষু দুইটি কামধেনুর মত অজস্র অশ্রু বর্ষণ করে। বক্ত্রী-চূড়ামণি অনেকবার অশ্রুবৃষ্টি করিয়া একবার জাঁকাইয়া কাঁদিবার উদ্যোগে ছিলেন; কিন্তু ভাগ্যক্রমে কথিত চক্ষু দুইটি সেই সময় সেই শিশুটির কালিময় মুখের উপর পড়িল; শিশুটি মসীপাত্র শূন্য করিয়া অন্ধকারময় মূর্ত্তি লইয়া দণ্ডায়মান ছিল, বালকের এই অপরূপ অঙ্গরাগ দেখিয়া গৃহযন্ত্রণাবাদিনী কাঁদিতে গিয়া হাসিয়া ফেলিলেন; রসের সাগর উথলিয়া যন্ত্রণাদি ভাসাইয়া দিল।
রোদনাদির ব্যাপার সমাপ্ত হইলে, সূর্য্যদেবকে সত্য সত্যই অস্তাচলে যাইবার উদ্যোগী দেখিয়া বক্ত্রী তরুণীকে জল আনিতে যাইবার আমন্ত্রণ করিলেন। বস্তুতঃ এই আমন্ত্রণের জন্যই এত দূর আসা। নবীনা বারি-বাহনার্থ যাইতে অস্বীকৃতা হইলেন; কিন্তু তাঁহার সঙ্গিনী বিশেষ উত্তেজনা করিতে লাগিলেন। নবীনা কহিলেন, “মধুমতীতে বড় কুমীর, গেলে কুমীরে খাবে।”