পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রচনা
বৃত্রসংহার*
এই মহাকাব্যের বিষয়, ইন্দ্রকৃত বৃত্রের বধ। হেমবাবু পৌরাণিক বৃত্তান্তের অবিকল অনুসরণ করেন নাই—অনেক স্থানেই নিজ কল্পনাকে স্ফুরিত করিয়াছেন। পাতালে, বৃত্রজিত, নির্বাসিত দেবগণ মন্ত্রণায় নিযুক্ত। এই স্থানে গ্রন্থারম্ভ। প্রথম সর্গ পড়িয়া অনেকেরই পাণ্ডিমোনিয়ামে মন্ত্রণানিযুক্ত দেবদূতগণের কথা মনে পড়িবে। হেমবাবু স্বয়ং স্বীকার করিয়াছেন যে, “বাল্যাবধি আমি ইংরাজিভাষা অভ্যাস করিয়া আসিতেছি এবং সংস্কৃতভাষা অবগত নহি, সুতরাং এই পুস্তকের অনেক স্থানে যে ইংরাজি গ্রন্থকারদিগের ভাবসঙ্কলন এবং সংস্কৃতভাষার অনভিজ্ঞতা-দোষ লক্ষিত হইবে তাহা বিচিত্র নহে।” হেমবাবু, মিল্টনের অনুসরণ করিয়া থাকুন বা না থাকুন, তিনি এ অংশেও যে স্বকীয় কবিত্বশক্তির বিশেষ পরিচয় দিয়াছেন, তাহা পাঠমাত্রেই সহৃদয় ব্যক্তি বুঝিতে পারিবেন। “নিবিড়ধূম্রল ঘোর” সেই পাতালপুরীর মধ্যে, সেই দীপ্তিশূন্য অমরগণের দীপ্তিশূন্য সভা—অল্পশক্তির সহিত বর্ণিত হয় নাই। একটি শ্লোক বিশেষ ভয়ঙ্কর—
চারি দিকে সমুত্থিত অস্ফুট আরাব
ক্রমে দেব-বৃন্দমুখে ফুটে ঘন ঘন,
ঝটিকার পূর্বে যেন ঘন ঘনচ্ছ্বাস
বহে যুড়ি চারি দিক আলোড়ি সাগর।
স্বর্গভ্রষ্ট দেবগণ সেই তমসাচ্ছন্ন, ভীমশব্দপূর্ণ সভাতলে বসিয়া, পুনর্বার স্বর্গ আক্রমণের পরামর্শ করিতে লাগিলেন। দেবমুখে সন্নিবেশিত বাক্যগুলিতে একটি অর্থ আছে; বোধ করি সকলেই টিপ্পনীতে তাহা বুঝিতে পারিবেন। অধিক উদ্ধৃত করিবার আমাদিগের স্থান নাই; উদাহরণস্বরূপ তিনটি শ্লোক উদ্ধৃত করিতেছি।
“ধিক্ দেব! ঘৃণাশূন্য, অক্ষুব্ধ-হৃদয়,
এত দিন আছ এই অন্ধতমপুরে;
দেবত্ব, বিভব, বীর্য, সর্ব তেয়াগিয়া
দাসত্বের কলঙ্কেতে ললাট উজ্জ্বলি।
“ধিক্ সে অমরনামে, দৈত্যভয়ে যদি
অমরা পশিতে ভয় কর দেবগণ,
অমরতা পরিণাম পরিশেষে যদি
দৈত্য-পদরজঃ পৃষ্ঠে করহ ভ্রমণ।
“বল হে অমরগণ—বল প্রকাশিয়া
দৈত্যভয়ে এইরূপে থাকিবে কি হেথা?
চির অন্ধকার এই পাতাল প্রদেশে,
দৈত্য-পদ-রজঃ—চিহ্ন বক্ষে সংস্থাপিয়া?”
এত দিন আছ এই অন্ধতমপুরে;
দেবত্ব, বিভব, বীর্য, সর্ব তেয়াগিয়া
দাসত্বের কলঙ্কেতে ললাট উজ্জ্বলি।
“ধিক্ সে অমরনামে, দৈত্যভয়ে যদি
অমরা পশিতে ভয় কর দেবগণ,
অমরতা পরিণাম পরিশেষে যদি
দৈত্য-পদরজঃ পৃষ্ঠে করহ ভ্রমণ।
“বল হে অমরগণ—বল প্রকাশিয়া
দৈত্যভয়ে এইরূপে থাকিবে কি হেথা?
চির অন্ধকার এই পাতাল প্রদেশে,
দৈত্য-পদ-রজঃ—চিহ্ন বক্ষে সংস্থাপিয়া?”
* বৃত্রসংহার কাব্য। প্রথম খণ্ড। শ্রীহেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় বিরচিত। শ্রীক্ষেত্রনাথ ভট্টাচার্য কর্তৃক প্রকাশিত। কলিকাতা।