পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রচনা
বঙ্গে দেবপূজা
প্রতিবাদ
কার্তিক মাসের ভ্রমরে শ্রীঃ স্বাক্ষরিত “বঙ্গে দেবপূজা” নামক প্রবন্ধ সম্বন্ধে আমার কিছু বলিবার কথা আছে।
শ্রীঃ মহাশয়ের কথার রীতিমত প্রতিবাদ করিতে গেলে যে সময় লাগে তাহা আমার নাই; এবং যে স্থান লাগে তাহা ভ্রমরের নাই। কিন্তু কথা সহজ-সংক্ষেপে বলিলেই চলিবে।
তাহার স্থূল কথা এই যে, পৌত্তলিকমত, সত্য হউক, মিথ্যা হউক, ইহা বঙ্গদেশে প্রচলিত থাকাতে, দেশের বিশেষ উপকার আছে। কি কি উপকার?
তিনি, প্রথম উপকার, এই দেখান যে, দেবসেবার অনুরোধে সেবক ভাল খায় পরে। এবং এই কথা প্রতিপন্ন করিবার জন্য বৈষ্ণবের বাড়ী ব্রাহ্ম অতিথির উদাহরণ দিয়াছেন। শ্রীঃ মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করি, যাহারা ঠাকুরপূজা করে না, তাহারা কি কখন ভাল খায় পরে না? শ্রীঃ মহাশয় কি তখন সাহেবদিগের আহার দেখেন নাই, তাহারা কয়টা শালগ্রামের ভোগ দেয়? হিন্দু পুত্তল পূজা করে, ইংরেজ করে না; ইংরেজ ভাল খায়, না হিন্দু ভাল খায়? ইংরেজ। তবে আহারাদির পারিপাট্য যে ঠাকুরপূজার ফল নহে, তাহা শ্রীঃ মহাশয়কে স্বীকার করিতে হইবে।
তিনি হয়ত বলিবেন, ইহা সত্য, তবে বাঙ্গালি এমন জাতি যে, যাহা কিছু ভাল খায়, তাহা ঠাকুরের অনুরোধে, ঠাকুর না থাকিলে খাইত না। এ কথা মিথ্যা। অনেক ঘোর নাস্তিক, উৎকৃষ্ট আহার করে, এবং অনেক দৃঢ়ভক্ত কানাইয়া লালকে এমন কদন্ন ভোগ দেয় যে, তাহার গন্ধে ভূত প্রেত পালায়। স্থূল কথা এই যে, যাহার শক্তি ও সংস্কার আছে, সেই ভাল খায়। যে এখন ঠাকুরকে উপলক্ষ করিয়া ভাল খায়, বা খাওয়ায় সে পৌত্তলিক না হইলে উদরের অনুরোধে ভাল খাইত, খাওয়াইত। শ্রীঃ মহাশয় দ্বিতীয় উপকারটি বঙ্গমহিলা সম্বন্ধে দেখাইয়াছেন। লিখেন, “প্রকৃত ঈশ্বরের নিকট থাকায় যে ফল, তাহা তাহাদের ফলিতেছে।” শ্রীঃ মহাশয় সে ফল কি আপনি জানেন? সে ফল পুরুষোত্তম, কাশী, প্রভৃতি তীর্থস্থানে প্রকটিত আছে। ঈশ্বরসান্নিধ্য হিন্দু মহিলার নিকট নিঃশঙ্কচিত্তে পাপ করিবার স্থান বলিয়া পরিচিত।
তিনি বলেন, সাকারে প্রার্থনা আন্তরিক হয়, নিরাকারে তত হয় না। কে বলিয়াছে? কেন হয় না? যাহাকে চাক্ষুষ মাটি বা পাতর দেখিতেছি, তাহার কাছে যদি আন্তরিক কাঁদিতে পারি, তবে যাঁহাকে চক্ষে দেখিতেছি না, কিন্তু মনে জানিতেছি তিনি ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিয়া আছেন, কেন তাঁহার কাছে আন্তরিক কাঁদিতে না পারিব? কেন সেইরূপ সান্ত্বনা লাভ না করিব? শ্রীঃ যুবতীর মুখে যে কয়টি কথা বসাইয়াছেন, তাহা মেয়েলি কথা বলিয়া উত্তর দিতে ইচ্ছা করে না। যুবতী স্ত্রীবুদ্ধিতে অলীক কথা বলিয়াছে, ভক্ত নিরাকারবাদীর অন্তঃকরণ বুঝিতে পারে না বলিয়া বলিয়াছে। দেবতার কাছে আছি বলিয়া, তাহার যে সুখ, যে সাহস, সর্বব্যাপী ঈশ্বরের কাছে আছি বলিয়া নিরাকার ভক্তেরও সেই সুখ, সেই সাহস। বিশ্বাসের দার্ঢ্য থাকিলে সাকার নিরাকারে কোন প্রভেদ নাই।