কার্যবিধি আইন সম্বন্ধে আর একটি কথা আমাদিগের বলিতে বাকি আছে। ব্রিটিশ-ভারতবর্ষীয় রাজ্যে সর্বাপেক্ষা তিমিরময় কলঙ্ক-দেশী বিদেশীতে বিচারাগারে বৈষম্য। দেশীর জন্য এক আইন আদালত-সাহেবের জন্য ভিন্ন আদালত। এই লজ্জাকর কলঙ্ক মেকলে হইতে লরেন্স পর্যন্ত অনেকে অপনীত করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন—কেহ শক্ত হয়েন নাই। সর্ জর্জ কাম্বেল হইতে সেই কার্য কিয়দংশে সিদ্ধ হইতেছে। এ বিষয়ে তিনি দেশীয় লোকের পরম বন্ধুর কার্য করিয়াছিলেন । অন্য কেহ করিলে, এত দিন তাঁহার সুখ্যাতিতে দেশ পুরিয়া যাইত। সর্ জর্জ কাম্বেল এ কার্য করিয়াছেন বলিয়া সে কথার কোন উচ্চবাচ্য নাই।

উচ্চশিক্ষার বিরুদ্ধাচরণ তাঁহার আর একটি নিন্দার কারণ। যিনি কোন প্রকার শিক্ষার বিরুদ্ধাচরণ করেন, তিনি মনুষ্যজাতির শত্রুর মধ্যে গণ্য। তবে ইহা স্মরণ করিতে হইবে যে, সকল মনুষ্যেরই শিক্ষায় সমান অধিকার। শিক্ষায় ধনীর পুত্রের যে অধিকার, কৃষকপুত্রের সেই অধিকার। রাজকোষ হইতে ধনীদিগের শিক্ষার জন্য অধিক অর্থব্যয় হউক, নির্ধনদিগের শিক্ষায় অল্প ব্যয় হউক, ইহা ন্যায়বিগর্হিত কথা। বরং নির্ধনদিগের শিক্ষার্থ অধিক ব্যয় এবং ধনীদিগের শিক্ষার্থ অল্প ব্যয়ই ন্যায়সঙ্গত; কেন না, ধনীগণ আপন ব্যয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত হইতে পারে, কিন্তু নির্ধনগণ সংখ্যায় অধিক, এবং রাজকোষ ভিন্ন অনন্যগতি। কিন্তু ভারতবর্ষীয় ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্ট পূর্বাপর শিক্ষার্থে সে প্রণালীতে ব্যয় করিয়া আসিয়াছেন, তাহা ন্যায়ানুমোদিত নহে। ধনীর শিক্ষার্থই সে ব্যয় হইয়া আসিতেছে; দরিদ্রের শিক্ষার্থ প্রায় নহে। যখন ইণ্ডিয়ান গবর্ণমেণ্ট হইতে সে প্রথা পরিবর্তন করিয়া, ধনীর শিক্ষার ব্যয়ের লাঘব করিয়া, দরিদ্র শিক্ষার ব্যয় বাড়াইবার প্রস্তাব হইয়াছিল, তখন সর্ উইলিয়ম গ্রে “উচ্চশিক্ষা! উচ্চশিক্ষা!” করিয়া সে প্রস্তাবের প্রতিবাদ করিয়া, দেশের লোকের প্রিয় হইয়াছিলেন বটে, কিন্তু দেশের মঙ্গল করেন নাই। যদি উচ্চশিক্ষার ব্যয় হইতে কিছু টাকা লইয়া তাহা দরিদ্রশিক্ষায় ব্যয় করিবার জন্য সর্ জর্জ কাম্বেল উচ্চশিক্ষার ব্যয় কমাইয়া থাকেন, তবে আমরা তাঁহার নিন্দা করিতে পারি না।

আরও কয়েকটি বিষয়ে সমালোচনার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু স্থানাভাবে এ প্রস্তাবের আর সম্প্রসারণ করিতে পারিলাম না। উপসংহারে বক্তব্য যে, যদি কেহ আমাদিগকে জিজ্ঞাসা করে যে, সর্ জর্জ কাম্বেলের কৃত এমন কি কার্য আছে যে তজ্জন্য সর্ জর্জের কিছু প্রশংসা করিতে পারি? আমরা তাহা হইলে বলিব যে, দুর্ভিক্ষ সম্বন্ধে তিনি উপকার করিয়াছেন, ব্রিটিশজাত প্রজাকে এতদ্দেশীয় আদালতের বিচারাধীন করিয়াছেন, প্রবিনসিয়াল আয় ব্যয়, তাঁহার হস্তে যেরূপ সুনিয়মবিশিষ্ট ছিল। পক্ষান্তরে যদি কাহাকে আমরা জিজ্ঞাসা করি যে, সর্ উইলিয়ম গ্রের কৃত এমন কোন কার্য আছে যে, তজ্জন্য আমরা তাঁহার নাম স্মরণ করি প্রশংসা করিতে পারি, তাহা হইলে তিনি কি উত্তর দিবেন? উচ্চশিক্ষার পক্ষ সমর্থন?

অনেকে এই প্রস্তাব পাঠ করিয়া লেখকের প্রতি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইবেন। এদেশীয় লোকের মধ্যে অনেকের বিশ্বাস আছে যে, সর্ জর্জ কাম্বেল, মনুষ্যাকারে পিশাচ ছিলেন। আমরা পিশাচ বলিয়া তাঁহাকে বর্ণিত করি নাই। তিনি বহু দোষযুক্ত ছিলেন, কিন্তু তাঁহার দোষের বর্ণনার অভাব নাই। যাহার অনেক দোষ, তাহার কোন গুণ আছে কি না, এ বিষয়ে সমালোচনার ফল আছে—যে এক চক্ষে দেখে সে অর্ধেক অন্ধ। এ প্রস্তাবের জন্য, যদি কেহ রাগ করেন, আমাদের আপত্তি নাই। কোন শ্রেণীর পাঠকের সন্তোষের কামনায় কোন প্রকার কথা এ পত্রে লিখিত হয় না; কোন শ্রেণীর পাঠকের অসন্তোষের আশঙ্কায় কোন কথা ব্যক্ত করিয়া বলিতে, এ পত্রের লেখকেরা সঙ্কুচিত নহেন। বর্তমান লেখক সর্ জর্জ কাম্বেল কর্তৃক কোন অংশে উপকৃত বা সর্ উইলিয়ম গ্রে কর্তৃক কোন অংশে অপকৃত নহেন ; যাহা লিখিত হইল, সত্যানুরোধেই লিখিত হইল। এদেশে অন্ধ অন্ধকে পথ দেখাইতেছে ; ভ্রান্ত ভ্রান্তকে উপদেশ দিতেছে। যদি এই প্রবন্ধের সাহায্যে কেহ এ কথাটি হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন, তাহা হইলেই এ প্রস্তাবের সার্থকতা হইল।

শ্রীভজরাম।—‘বঙ্গদর্শন’, জ্যৈষ্ঠ ১২৮১, পৃ. ৭৩-৮২।