পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রচনা
এস্থলে এ কথা বলিলে তাঁহার মনের ভাব কতক প্রকাশ হইবেক যে, ফরাসিদেশে আডিনে নামক নগরের এক গির্জার সমাধিক্ষেত্রে মিলের স্ত্রী সমাধিস্থ হয়েন এবং ঐ সমাধি সর্বদা দেখিতে পাইবেন বলিয়া মিল তাহার নিকটবর্তী একটি বাটী ক্রয় করেন। সেই বাটীতে এরিসিপেলাস রোগে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে।
দ্বিতীয়; মিলের কল্পনা এই যে পৃথিবীর ভূমিসম্পত্তির উপস্বত্ব ক্রমশঃই বর্ধিত হইতেছে; ইহার কিয়দংশ কেবল মাত্র সভ্যতার উন্নতিজনিত; তাহাতে কাহারও আয়াস বা অর্থব্যয় হয় না, কিন্তু কেবল কতিপয় ভূম্যধিকারীই তাহার ফলভোগী হয়েন। যদ্যপি উপস্বত্বের এই বর্ধিত অংশ রাজহস্তে সমর্পিত হয়, তবে ক্রমশঃ রাজকরের লাঘব হইয়া রাজ্যস্থ তাবৎ লোকেই ইহার কিছু কিছু অংশ পাইতে পারেন। অতএব ইহার সদুপায় করা কর্তব্য। মিল এই কার্যে অতি অল্পদিন হইল হস্তক্ষেপণ করিয়াছিলেন, তাঁহার মৃত্যুর পরে যে হঠাৎ আর কেহ ইহাতে প্রবৃত্ত হইবেন, বোধ করি তাহার সম্ভাবনা অল্প।
মিল প্রথমাবস্থায় অনেক বিষয়ে কোম্তের সহিত একমত ছিলেন কিন্তু পরিণামে নানা মতভেদ উপস্থিত হয়। আমরা মনে করি যে পরস্পরের বিবাদের স্থূল কথা এই যে,—
ব্যক্তিবিশেষ ও জনসমাজ এতদুভয় মধ্যে, মিলের মতে ব্যক্তির প্রাধান্য রক্ষা করিয়া সমাজের উন্নতিসাধন করিতে হইবেক নতুবা পৃথিবী ক্রমশঃ নিস্তেজ হইয়া যাইবেক।
আর কোম্ৎ বলেন যে, সহস্র চেষ্টা করিলেও মনুষ্যের স্বার্থানুরাগ পরহিতৈষিতা অপেক্ষা ক্ষুণ্ণ হইবেক না; ব্যক্তিবিশেষের প্রাধান্য রক্ষার্থ যত্ন প্রয়োগ হইলে, সে যত্নের দ্বারা সমাজের যে উন্নতি হইতে পারিত তাহার ব্যাঘাত হইবেক। অতএব স্বার্থানুরাগ কেবল দমন করিবার চেষ্টা করাই কর্তব্য।
মিল ও কোম্তের ন্যায় মহোপাধ্যায়গণ যে সকল বিষয়ের ঐক্যমত সংস্থাপন করিতে পারেন নাই, তাহার কোন পক্ষের মত সমর্থন করা সামান্য লোকের পক্ষে অবশ্যই অসাধ্য। সুতরাং মতদ্বয় মধ্যে কোন্টি শ্রেষ্ঠ এবং কোন্টি নিকৃষ্ট তদ্বিষয়ে আমরা কোন কথা বলিতে পারি না। কিন্তু এই পর্যন্ত বলিতে ইচ্ছা করি যে, মিল, কোম্ৎ দর্শন বিচার করিবার জন্য Auguste Comte and Positivism নামক যে পুস্তক রচনা করিয়াছেন, তাহাতে জনসমাজের কথঞ্চিৎ ক্ষতি হইয়াছে। কিন্তু তাহা মিলের অভিপ্রেত নহে বলিয়া তজ্জন্য মিলকে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না। অনেকে কোম্তের গ্রন্থ পাঠ করা দুরূহ বলিয়া মিলের গ্রন্থ হইতে তাঁহার মতের সার সংগ্রহ করিবার চেষ্টা করেন। কিন্তু ইহার পরিণাম কেবল এই মাত্র হয় যে, যেমন কিছুদিন পূর্বে খৃষ্টান মহাশয়েরা সকল কথা না বুঝিয়া কেবল হিন্দুধর্মের প্রতি ব্যঙ্গ করিতেই পটু হইতেন, মিলকৃত কোম্ৎভাষ্যের পাঠক মহাশয়েরাও তদ্রূপ কেবল ব্যঙ্গ করিবার ক্ষমতা লাভ করেন।
মিলের ধর্ম বিষয়ে আমরা কোন কথা বলিতে ইচ্ছা করি না, কারণ তিনি নিজে তাহা পরিষ্কাররূপে ব্যক্ত করেন নাই। ইহাতে তিনি নিন্দাভাজন হইয়াছেন কি না তদ্বিষয়ে দ্বিমত থাকিতে পারে। কিন্তু যদি তিনি স্বয়ং আপন প্রকৃত বিশ্বাস গোপন করিবার চেষ্টা করিয়া থাকেন, তবে অন্যের পক্ষে তাহার আন্দোলন করা বন্ধুর কার্য হইতে পারে না।
আমরা এতক্ষণ যে সকল বিষয়ের আলোচনা করিতেছিলাম, তাহাতে আমরা সমগ্র মানব জাতির সহিত ভ্রাতৃসম্পর্কে আবদ্ধ। কিন্তু ভারতবাসী বলিয়া মিলের সহিত আমাদের আরো কিছু সম্পর্ক আছে। যৎকালে ভারতবর্ষ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃত্বাধীন ছিল তখন মিল প্রথমতঃ ইষ্ট ইণ্ডিয়া হাউসের একজন কেরানি এবং পরিশেষে চিঠিপত্র-পরীক্ষকের কার্য করিতেন। কোর্ট অব্ ডাইরেকটর হইতে ভারতবর্ষে যে সকল আজ্ঞালিপি আসিত তাহা মিলের পরীক্ষা ভিন্ন প্রেরিত হইত না। কিম্বদন্তী আছে যে, ভারতবর্ষের বিদ্যাশিক্ষাবিষয়ক সন ১৮৫৪ সালের প্রসিদ্ধ লিপিরচনাকার্যে মিলের বিশিষ্ট সাহায্য ছিল। ফলতঃ উহাতে যেরূপ নিয়ম নির্দিষ্ট হইয়াছে তাহার সহিত মিলের Liberty নামক পুস্তকোক্ত মতের সম্পূর্ণ ঐক্য লক্ষিত হইবেক।