পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রচনা
বঙ্গদর্শনের প্রথম প্রচারকালে কার্যাধ্যক্ষ সাধারণ সমক্ষে প্রতিশ্রুত হইয়াছিলেন যে, এই পত্রে ধর্ম সম্প্রদায়ের মতামতের সমালোচনা হইবে না। আমরা সেই প্রতিজ্ঞায় বদ্ধ। সেই প্রতিজ্ঞালঙ্ঘন না করিলে আমরা এ প্রবন্ধের উপযুক্ত সমালোচনা করিতে পারি না, কেন না তাহা করিতে গেলে হিন্দু ধর্মের দোষ গুণ বিচার করিতে হয়। অতএব আমরা ইহার প্রকৃত সমালোচনায় প্রবৃত্ত হইতে পারিলাম না, ইহা আমাদের দুঃখ রহিল।
কিন্তু সে তত্ত্বের আলোচনায় প্রবৃত্ত না হইয়াও যদি একজন হিন্দুবংশজাত লেখক বলেন যে, আমাদের দেশের ধর্ম সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম, ইহা একজন সুপণ্ডিত লোকের নিকট শুনিয়া সুখ হইল, তবে বোধ করি, অন্য ধর্মাবলম্বী লোকেও তাঁহাকে মার্জনা করিবেন।
আমরা বলিতেছি, এ কথা শুনিয়া আমাদের সুখ হইল, কিন্তু এ কথা আমরা যথার্থ বলিয়া স্বীকার করিতেছি না, বা অযথার্থ বলিয়া অগ্রাহ্য করিতেছি না। হিন্দু ধর্ম অন্য ধর্মাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কি না, তদ্বিষয়ে কোন অভিমত ব্যক্ত না করিয়া, নিম্নলিখিত কয়েকটি কথা, বোধ হয়, বলা যাইতে পারে।
লেখক যাহাকে স্বয়ং হিন্দু ধর্ম বলেন, তাহারই শ্রেষ্ঠত্ব সংস্থাপনই যে তাঁহার উদ্দেশ্য, ইহা অবশ্য অনুমেয়। তিনি বলেন যে, ব্রহ্মোপাসনাই হিন্দু ধর্ম। অতএব ব্রহ্মোপাসনা যে শ্রেষ্ঠ ধর্ম, কেবল তাহাই সমর্থন করা তাঁহার উদ্দেশ্য। এ দেশের সাধারণ ধর্মের শ্রেষ্ঠতা প্রতিপাদন করা তাঁহার উদ্দেশ্য নহে। হিন্দু ধর্ম সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ—কিন্তু আমাদের দেশের চলিত ধর্ম শ্রেষ্ঠ, এমত কথা তিনি বলেন না। যে ধর্মকে তিনি শ্রেষ্ঠ বলেন, তৎসম্বন্ধে লোকের বড় মতভেদ নাই। পরব্রহ্মের উপাসনা—সকল ধর্মের অন্তর্গত—সকলেরই সারভাগ।
রাজনারায়ণ বাবু নিজ প্রশংসিত ধর্মের মূলস্বরূপ বেদাদি হিন্দু শাস্ত্রের উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি যে ধর্মের উল্লেখ করিয়াছেন, তাহার মূল হিন্দু শাস্ত্রে আছে, ইহা যথার্থ। কিন্তু উহা হিন্দু ধর্মের একাংশ মাত্র—অতি অল্পাংশ। কোন পদার্থের অংশ মাত্রকে সেই পদার্থ কল্পনা করায় সত্যের বিঘ্ন হয়। অংশ মাত্র গ্রহণ করিয়া সকল পদার্থেরই প্রশংসা করা যায়। রাজনারায়ণ বাবু যেমন হিন্দু ধর্মের অংশবিশেষ গ্রহণ করিয়া ঐ ধর্মের প্রশংসা করিয়াছেন, তেমনি ঐ ধর্মের অপরাংশ গ্রহণ করিয়া তাঁহার সকল কথাই খণ্ডন করা যাইতে পারে। যেমন অঙ্গুরীয় মধ্যস্থ হীরককে অঙ্গুরীয় বলা যায় না, তেমনি কেবল ব্রহ্মোপাসনাকে হিন্দু ধর্ম বলা যায় না। যেমন কলিকাতাকে ভারতবর্ষ বলা যায় না, তেমনি কেবল ব্রহ্মোপাসনাকে হিন্দু ধর্ম বলা যায় না। উপধর্ম হইতে বিচ্ছিন্ন পরিশুদ্ধ ব্রহ্মোপাসনা কোন কালে একা ভারতবর্ষে বা ভারতবর্ষের কোন প্রদেশে বা আধুনিক ব্রাহ্ম ভিন্ন কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত ছিল কি না, সন্দেহ। যদি এ কথা যথার্থ হয়, তবে ব্রাহ্মধর্মেরই শ্রেষ্ঠতা সংস্থাপন লেখকের উদ্দেশ্য বলিতে হইবে। বোধ হয়, রাজনারায়ণ বাবু এ কথা অস্বীকার করিবেন না।
ইহাতে আমরা লেখকের অপ্রশংসা করিতেছি না। স্বমত সংস্থাপনে সকলেরই অধিকার আছে। বিশেষ ব্রাহ্ম পরিবর্তে হিন্দু কথাটি ব্যবহারে বিশেষ উপকার আছে। হিন্দু ধর্মের সহিত ব্রাহ্ম ধর্মের একতা স্বীকার করায় আমাদের বিবেচনায় উভয় সম্প্রদায়ের মঙ্গল। আমি যদি অন্যের সহিত পৃথক হইয়া একা কোন সদনুষ্ঠানে রত হই, তবে আমার একারই উপকার; যদি সকলের সঙ্গে মিলিত হইয়া সে সদনুষ্ঠানে রত হই, তবে সকলেই তাহার ফলভোগী হইবে। অল্প লোক লইয়া একটি নূতন সম্প্রদায় স্থাপনের অপেক্ষা বহু লোকের সঙ্গে পুরাতন ধর্মের পরিশোধন ভাল। কেন না তাহাতে বহু লোকের ইষ্ট সাধন হয়। আমরা হিন্দু কোন সম্প্রদায়ভুক্ত নহি; কোন সম্প্রদায়ের আনুকূল্যে এ কথা বলিলাম না; হিন্দু জাতির আনুকূল্যেই এ কথা বলিলাম।
অন্যান্য বিষয়ে আমরা কোন কথা বলিতে ইচ্ছুক নহি বলিয়া গ্রন্থকারের রচনার প্রশংসা করিয়া আমরা ক্ষান্ত হইব। এই প্রবন্ধের রচনাপ্রণালী অতি পরিপাটি। লেখক অতি পরিশুদ্ধ, অথচ সকলের বোধগম্য এবং শ্রুতিসুখদ ভাষায় আপন বক্তব্য প্রকাশিত করিয়াছেন। মিথ্যা বাগাড়ম্বর পরিত্যাগ করিয়া প্রয়োজনীয় কথায় সুচারুরূপে কার্য সমাধা করিয়াছেন। তাঁহার সংগ্রহও প্রশংসনীয়। সর্বাপেক্ষা তাঁহার প্রবন্ধের শেষ ভাগে সন্নিবেশিত জয়োচ্চারণ আমাদের প্রীতিপদ হইয়াছে। আমরা তাহা উদ্ধৃত করিয়া পাঠকদিগকে উপহার দিলাম। ইহাতে নূতন কথা কিছু নাই, কিন্তু এরূপ পুরাতন কথা যদি হৃদয় হইতে নিঃসৃত হয়, তবে তাহাতেই আমাদের সুখ। রাজনারায়ণ বাবুর হৃদয় হইতে এ কথা নিঃসৃত হইয়াছে বলিয়াই, তাহাতে আমাদের সুখ।