পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রচনা
প্রাপ্ত গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত সমালোচন
হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠতা। শ্রীরাজনারায়ণ বসু প্রণীত। কলিকাতা জাতীয় যন্ত্র।
এই গ্রন্থ, এবং ইহার পরে যে গ্রন্থের উল্লেখ করা যাইতেছে, এই দুই গ্রন্থের সমালোচনায় প্রবৃত্ত হইয়া, আমরা একটি আনন্দ অনুভব করিতেছি। আমরা সচরাচর বাঙ্গালা গ্রন্থের অপ্রশংসা করিয়া থাকি। তাহাতে লেখকদিগেরও অসুখ, আমাদিগেরও অসুখ। লেখক মাত্রের দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে “আমার প্রণীত গ্রন্থ সর্বাঙ্গসুন্দর, অনিন্দনীয়, এবং রামায়ণ হইতে আজি পর্যন্ত যত গ্রন্থ প্রণীত হইয়াছে, সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট।” সমালোচক যদি ইহার অন্যথা লেখেন, তবেই গ্রন্থকারের বিষম রাগ উপস্থিত হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে পৃথিবী মধ্যে যত দেশে যত গ্রন্থকার জন্মগ্রহণ করিয়া লোকপীড়া জন্মাইয়াছেন, তন্মধ্যে সাধারণ বাঙ্গালী গ্রন্থকার সর্বাপেক্ষা অপকৃষ্ট। সুতরাং তাঁহাদিগের আমরা প্রশংসা করি না। অপ্রশংসা দেখিয়া, লেখক সম্প্রদায় আমাদিগের প্রতি রাগ করেন। সভ্য জাতীয়দিগের মধ্যে কাহারও এরূপ রাগ হইলে, তিনি সে রাগ গায়ে মারেন; দুই একজন ব্যাকুল গ্রন্থকার কদাচিৎ সমালোচনার প্রতিবাদ করেন। কিন্তু বাঙ্গালীর স্বভাব সেরূপ নহে। বাঙ্গালী অন্য যে কার্যে পরাঙ্মুখ হউন না কেন, কলহে কদাপি পরাঙ্মুখ নহেন। সমালোচনায় অপ্রশংসা দেখিলেই তাহার প্রতিবাদ করিতে হইবে—প্রতিবাদ করিতে গেলে এ সম্প্রদায়ের লেখকদিগের দৃঢ় বিশ্বাস আছে যে, ভদ্রলোকের ভাষা এবং ভদ্রলোকের ব্যবহার বর্জ্জনীয়। যে দেশে অল্পকাল হইল, কবির লড়াই ভদ্রলোকের প্রধান আমোদ ছিল—যে দেশে অদ্যাপিও পাঁচালি প্রচলিত, যে দেশের লোক অশ্লীল গালিগালাজ ভিন্ন অন্য গালি জানে না, সে দেশের ক্রুদ্ধ লেখকেরা যে রাগের সময়ে আপনাপন শিক্ষা এবং সংসর্গের স্পষ্ট পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত হইবেন না, তাহা সহজেই অনুমেয়। কখন কখন দেখিয়াছি যে মহাসম্ভ্রান্ত দেশমান্য ব্যক্তিও আপনার সম্মানের ত্রুটি হইয়াছে বিবেচনা করিয়া, রাগান্ধ হইয়া ইতরের আশ্রয় অবলম্বন করিয়াছেন এবং মাতৃভাষাকে কলুষিত করিয়াছেন। কখন কখন দেখিয়াছি, রাগান্ধ লেখকেরা সমালোচনার মর্ম গ্রহণ করিতেও অক্ষম। যদি আমরা কোন পুস্তকান্তর্গত চর্বিত চর্বণকে ব্যঙ্গ করিয়া “নূতন” বলিয়াছি, গ্রন্থকার মনে করিয়াছেন যে, সত্য সত্যই তাঁহার কথাগুলিকে নূতন বলিয়াছি। যদি কোন গ্রন্থে দুই আর দুই চারি হয়, এমত কথা পাঠ করিয়া তাহা দুর্জ্ঞেয় বলিয়া ব্যঙ্গ করিয়াছি, অমনি গ্রন্থকার মনে করিয়াছেন যে, আমার আবিষ্কৃত তত্ত্ব সত্য সত্যই দুর্জ্ঞেয় বলিয়া, নিন্দা করিয়াছে। সুতরাং তিনি অধীর হইয়া প্রমাণ করিতে বসিয়াছেন যে, তাঁহার কথাগুলিন অতি প্রাচীন এবং সকলেরই জ্ঞানগোচর। কখন কখন দেখিয়াছি, কোন সামান্য অপরিচিত লেখক মনে মনে স্থির করিয়াছেন, আমরা ঈর্ষাবশতই তাঁহার গ্রন্থের নিন্দা করিয়াছি। এ সকল রহস্যে বিশেষ আমোদ প্রাপ্ত হইয়া থাকি বটে, কিন্তু কতকগুলিন ভাল মানুষকে যে মনঃপীড়া দিয়া থাকি, এবং তাঁহাদিগের বিরাগভাজন হই, ইহা আমাদিগের বড় দুঃখ। অতএব বঙ্গীয় পুস্তক সমালোচনা আমাদিগের বড় অপ্রীতিকর কার্য হইয়া উঠিয়াছে। কেবল কর্তব্যানুরোধেই আমরা তাহাতে প্রবৃত্ত। কর্তব্যানুরোধেই আমরা অনিচ্ছুক হইয়া অপ্রশংসনীয় গ্রন্থের অপ্রশংসা করিয়া থাকি। আমাদের নিতান্ত কামনা যে, প্রশংসনীয় গ্রন্থ আমাদিগের হাতে পড়ে আমরা প্রশংসা করিয়া লেখক সমাজকে জানাই যে, আমরা বিশ্বনিন্দুক নহি। আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে, এবং বাঙ্গালা ভাষার দুর্ভাগ্যক্রমে সেরূপ গ্রন্থ অতি বিরল। অদ্য দুইখানি প্রশংসনীয় গ্রন্থ আমাদিগের হস্তগত হইয়াছে। তাই আজি আমাদিগের এত আহ্লাদ। তাহার মধ্যে রাজনারায়ণ বাবুর গ্রন্থখানি প্রথমেই সমালোচনীয়।
হিন্দু ধর্ম যে সকল ধর্মের শ্রেষ্ঠ, এই কথা প্রতিপন্ন করা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য। গত ভাদ্র মাসে জাতীয় সভায় রাজনারায়ণ বাবু উপস্থিত মতে একটি বক্তৃতা করেন। তৎপরে তাহা স্মরণ করিয়া লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। তাহাতেই এ প্রস্তাবের উৎপত্তি।