সেইটুকু আমরা কেন শুনিতে চাই? তাহা আমরা বুঝাইতে পারিব কি না, বলিতে পারি না। আমরা বাঙ্গালী, ইংরাজ প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ জাতির তুলনায় আমরা অতি সামান্য জাতি বলিয়া গণ্য। ইংরাজের তুলনায় আমাদিগের কিছুই প্রশংসনীয় নহে। আমাদের কিছুই ভাল নহে। একথা সত্য কি না, তাহা আমরা ঠিক জানি না; কিন্তু প্রত্যহ শুনিতে শুনিতে আমাদের উহা সত্য বলিয়া বিশ্বাস হইয়া উঠিতেছে। সে বিশ্বাসটি ভাল নহে। ইহাতে আমাদের স্বদেশভক্তি স্বজাতির প্রতি শ্রদ্ধার হ্রাস হইতেছে। যাহাতে কিছু ভাল নাই—তাহা কে ভালবাসিবে? আমরা যদি অন্য জাতির অপেক্ষা বাঙ্গালী জাতির, অন্য দেশের অপেক্ষা বাঙ্গালা দেশের কোন বিশেষ গুণ না দেখি, তবে আমাদিগের দেশবাৎসল্যের অভাব হইবে। এই জন্য আমাদের সর্বদা ইচ্ছা করে যে, সভ্যতম জাতি অপেক্ষা আমরা কোন অংশে ভাল কি না, তাহা শুনি। কিন্তু কোথাও তাহা শুনিতে পাই না। যাহা শুনি তাহা সত্যপ্রিয় সুবিবেচকের কথা নহে। যাহা শুনি, তাহা শুদ্ধ স্বদেশপিঞ্জর মধ্যে পালিত মিথ্যাদম্ভপ্রিয় ব্যক্তিদের কথা,—তাহাতে বিশ্বাস হয় না—বাসনা পরিতৃপ্ত হয় না। যদি এই লেখকের ন্যায় সুশিক্ষিত, সুবিবেচক, বহুদেশদর্শী ব্যক্তির নিকট সে কর্ণানন্দদায়িনী কথা শুনিতে পাইতাম—তবে সুখ হইত। তাহা যে শুনিলাম না, সে লেখকের দোষ নহে—আমাদের কপালের দোষ। লেখক স্বদেশবিদ্বেষী বা ইংরাজপ্রিয় নহেন। তিনি স্বদেশবৎসল, স্বদেশবাৎসল্যে তাঁহার অন্তঃকরণ বিচলিত হইলে, তিনি প্রবাস হইতে স্বদেশ বিষয়ে যে সকল কবিতাগুলি লিখিয়া ভ্রাতাকে পাঠাইয়াছেন, তাহা আমাদের কর্ণে অমৃত বর্ষণ করে। কিন্তু আমরা দেখিতে পাই যে, গুণহীনা মাতার প্রতি সৎপুত্রের যে স্নেহ, সে স্নেহ কোথায়? এই বঙ্গদেশের প্রতি সে স্নেহ কাহার কাছে? সে স্নেহ কিসে হইবে? এ গ্রন্থ পাঠ করিয়া আমাদের সেই কথা মনে পড়িল। জন্মভূমি সম্বদ্ধে আমরা যে “স্বর্গাদপি গরিয়সী” বলিবার অধিকারী নই, আমাদের সেই কথা মনে পড়িল। সেই কথা মনে পড়ায়, আমরা এ আক্ষেপ করিলাম। যে মনুষ্য জননীকে “স্বর্গাদপি গরিয়সী” মনে করিতে না পারে সে মনুষ্যমধ্যে হতভাগ্য। যে জাতি জন্মভূমিকে “স্বর্গাদপি গরিয়সী” মনে করিতে না পারে সে জাতি জাতিমধ্যে হতভাগ্য। আমরা সেই হতভাগ্য জাতি বলিয়া এ রোদন করিলাম। লেখক যদি আমাদিগের মনের ভাব বুঝিয়া থাকেন, তবে তিনিও আমাদিগের সঙ্গে রোদন করিবেন। যদি কেহ সত্যপ্রিয়, দেশবৎসল বাঙ্গালী থাকেন, তিনি আমাদের সঙ্গে রোদন করিবেন।

আমরা গ্রন্থ সমালোচনা ত্যাগ করিয়া একটু অপ্রাসঙ্গিক কথা তুলিয়াছি, কিন্তু কথা নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিকও নহে। আমরা যে ভাব ব্যক্ত করিলাম, এই গ্রন্থের আলোচনায় সেই ভাবই বাঙ্গালীর মনে উদয় হইতে পারে। যদি সাধারণ বাঙ্গালীর মনে ইহা হইতে সেই ভাব উদিত হয়, তবে এ গ্রন্থ সার্থক। তাহা না হইলে ইহার মূল্য নাই।

এই গ্রন্থের প্রকৃত সমালোচনা সম্ভব না। কেন না, ইহা সাধারণ সমীপে প্রকাশিত করিবার অভিপ্রায়ে প্রথমে প্রণীত হয় নাই। সুতরাং রচনাচাতুর্য বা বিষয়ঘটিত পারিপাট্য ইহার উদ্দেশ্য নহে। ভ্রাতার সঙ্গে সরল কথোপকথনের স্বরূপ ইহা লিখিত হইয়াছিল। অতএব সমালোচক যে সকল দোষ গুণের সন্ধান করেন, ইহাতে তাহার সন্ধান কর্তব্য নহে। কিন্তু সন্ধান করিলেও দোষ ভাগ পাওয়া কঠিন হইবে, গুণ অনেক পাওয়া যাইবে। ভাষা সরল এবং আড়ম্বরশূন্য। ভাবও সরল, এবং আড়ম্বরশূন্য। লেখকের হৃদয়ও যে সরল এবং আড়ম্বরশূন্য, এই গ্রন্থ তাহার পরিচয়। লেখক সর্বত্রেই গুণগ্রাহী, উৎসাহশীল, এবং সুপ্রসন্ন। তাঁহার রুচিও সুন্দর, বুদ্ধি মার্জিত, এবং বিচারক্ষমতা অনিন্দনীয়। বিশেষ, তাঁহার একটি গুণ দেখিয়া আমরা বড় প্রীত হইয়াছি। চিত্রে বা খোদিত প্রস্তরে যে রস, বাঙ্গালীরা প্রায়ই তাহা অনুভূত করিতে পারেন না। বালকে বা চাষায় “সং” দেখিয়া যেরূপ সুখ বোধ করে, সুশিক্ষিত বাঙ্গালীরাও চিত্রাদি দেখিয়া সেইরূপ সুখ বোধ করেন। এই গ্রন্থের লেখক সে শ্রেণীর বাঙ্গালী নহেন। তিনি চিত্রাদির যে সকল সমালোচনা পত্রমধ্যে ন্যাস্ত করিয়াছেন, তাহাতে বিশেষ রসানুভাবকতা এবং সহৃদয়তা প্রকাশ পায়। ইউরোপে পর্যটন করিলে, ভুবনে অতুল্য চিত্রাদি দর্শনে, এবং তত্ত্ববিষয়ের বিচক্ষণ বিচারকদিগের সহবাসে যে বুদ্ধি মার্জিতা, এবং রসগ্রাহিণী শক্তি স্ফুরিতা হইবে, ইহা সঙ্গত। কিন্তু এ লেখকের রসগ্রাহিণী শক্তি স্বভাবজাতাও বটে। তিনি ইউরোপে প্রবেশ করিবার পূর্বেই মাল্টা নগরে “Charity”র গঠিত মূর্তি দেখিয়া লিখিয়াছেন;—