শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
ঈশ্বরের নিষ্কামকর্ম্মিত্ব না জানিলে, নিষ্কাম কর্ম্ম বুঝা যায় না। তাহা জানিলে কর্ম্ম নিষ্কাম হইবে। তাহা হইলে সকাম কর্ম্মরূপ বন্ধন হইতে অব্যাহতি পাওয়া যায়। পূর্ব্বশ্লোকের যে টীকা দেওয়া গিয়াছে, তাহাতে এ কথা পরিস্ফুট করা গিয়াছে।
এবং জ্ঞাত্বা কৃতং কর্ম্ম পূর্ব্বৈরপি মুমুক্ষুভিঃ।
কুরু কর্ম্মৈব তস্মাত্ত্বং পূর্ব্বৈঃ পূর্ব্বতমং কৃতম্ || ১৫ ||
কুরু কর্ম্মৈব তস্মাত্ত্বং পূর্ব্বৈঃ পূর্ব্বতমং কৃতম্ || ১৫ ||
এইরূপ জানিয়া পূর্ব্বকালের মোক্ষাভিলাষিগণ কর্ম্ম করিয়াছিলেন, তুমি পূর্ব্বগামীদিগের পূর্ব্বকাল-কৃত কর্ম্ম সকল কর। ১৫।
অর্থাৎ প্রাচীন কালে যাঁহারা মোক্ষকাম, তাঁহারা আপনাকে অকর্ত্তা জানিয়া-কর্ম্মের ফলভোগী নহি, ইহা জানিয়া কর্ম্ম করিতেন। তুমিও সেইরূপ কর্ম্ম কর।
কিং কর্ম্ম কিমকর্ম্মেতি কবয়োহপ্যত্র মোহিতাঃ।
তত্তে কর্ম্ম প্রবক্ষ্যামি যজ্জ্ঞাত্বা মোক্ষ্যসেহশুভাৎ || ১৬ ||
তত্তে কর্ম্ম প্রবক্ষ্যামি যজ্জ্ঞাত্বা মোক্ষ্যসেহশুভাৎ || ১৬ ||
কর্ম্ম কি, অকর্ম্ম কি, পণ্ডিতেরাও তাহা বুঝিতে পারেন না। অতএব কর্ম্ম কি, তাহা তোমাকে বলিতেছি। তাহা জানিলে অশুভ হইতে মুক্ত হইবে। ১৬।
অকর্ম্ম অর্থে এখানে মন্দ কর্ম্ম নহে-অকর্ম্ম অর্থে কর্ম্মশূন্যতা।
কর্ম্মণো হ্যপি বোদ্ধব্যং বোদ্ধব্যঞ্চ বিকর্ম্মণঃ।
অকর্ম্মণশ্চ বোদ্ধব্যং গহনা কর্ম্মণো গতিঃ || ১৭ ||
অকর্ম্মণশ্চ বোদ্ধব্যং গহনা কর্ম্মণো গতিঃ || ১৭ ||
কর্ম্ম কি, তাহা বুঝিতে হইবে, বিকর্ম্ম কি, তাহা বুঝিতে হইবে, এবং অকর্ম্ম কি, তাহা বুঝিতে হইব। কর্ম্মের গতি দুর্জ্ঞেয়। ১৭।
কর্ম্ম-অর্থে বিহিত কর্ম্ম, যাহা যথার্থ কর্ম্ম।
বিকর্ম্ম-অবিহিত কর্ম্ম।
অকর্ম্ম-কর্ম্মত্যাগ, কর্ম্মশূন্যতা।
কর্ম্মণ্যকর্ম্ম যঃ পশ্যেদকর্ম্মণি চ কর্ম্ম যঃ।
স বুদ্ধিমান্ মনুষ্যেষু স যুক্তঃ কৃৎস্নকর্ম্মকৃৎ || ১৮ ||
স বুদ্ধিমান্ মনুষ্যেষু স যুক্তঃ কৃৎস্নকর্ম্মকৃৎ || ১৮ ||
যে কর্ম্মেতেও কর্ম্মশূন্যতা দেখে, এবং অকর্ম্মেও কর্ম্ম দেখে, সেই মনুষ্যের মধ্যে বুদ্ধিমান্। সেই যোগযুক্ত, এবং সেই সর্ব্বকর্ম্মকারী। ১৮।
ভগবদারাধনা কর্ম্ম; কিন্তু তাহাতে কর্ম্মের যে বন্ধকতা, তাহা ঘটে না, এই জন্য তাহাকে কর্ম্মস্বরূপ বিবেচনা করিবে না। আর যে কর্ম্ম বিহিত, তাহা না করিলে তাহার ফলভাগী হইতে হয়, ফলভাগিত্ব মুক্তির রোধক; এ জন্য না করাকেই, অর্থাৎ অকর্ম্মকেই কর্ম্ম বিবেচনা করিবে। শ্রীধরের টীকার মর্ম্মার্থ এই। ইহাতে এ শ্লোক হইতে ইহাই পাওয়া যায় যে, ভগবদারাধনাই কর্ত্তব্য। অন্যান্য অনুষ্ঠান মুক্তির বিঘ্ন।
শঙ্করাচার্য্য অনুরূপ বুঝাইয়াছেন। তিনি এই শ্লোক উপলক্ষে একটি দীর্ঘ এবং জটিল প্রবন্ধ রচনা করিয়াছেন, তাঁহার স্থূল কথা এই-আত্মা ক্রিয়ানির্লিপ্ত; কর্ম্ম ইন্দ্রিয়াদির দ্বারাই কৃত হইয়া থাকে; কিন্তু ভ্রমক্রমেই আত্মাতে কর্ম্মারোপ হইয়া থাকে। যিনি ইহা জানেন, তিনি কর্ম্মে অকর্ম্ম দেখেন। আর ইন্দ্রিয়াদি বিহিতানুষ্ঠানে বিরত হইলেও সেই অকর্ম্মকেও তিনি ইন্দ্রিয়াদির কর্ম্ম দেখেন।
কিন্তু আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে, পরবর্ত্তী শ্লোকের উপর দৃষ্টি রাখিলে একটা সোজা অর্থ পাওয়া যায়। কামসঙ্কল্প-বিবর্জ্জিত, ফলকামনাশূন্য যে কর্ম্ম, সে অকর্ম্ম-কর্ম্মশূন্যতা। আর যিনি অনুষ্ঠেয় কর্ম্মে বিরত, তাঁহার কর্ত্তব্য-বিরতির ফলভাগিত্ব আছেই আছে-অতএব এখানে কর্ম্মশূন্যতাও কর্ম্ম। কেন না, ফলোৎপত্তির কারণ। যিনি ইহা বুঝিতে পারেন, তিনিই জ্ঞানী।
যস্য সর্ব্বে সমারম্ভাঃ কামসঙ্কল্পবর্জ্জিতাঃ।
জ্ঞানাগ্নিদগ্ধকর্ম্মাণং তমাহুঃ পণ্ডিতং বুধাঃ || ১৯ ||
জ্ঞানাগ্নিদগ্ধকর্ম্মাণং তমাহুঃ পণ্ডিতং বুধাঃ || ১৯ ||
যাঁহার সকল চেষ্টা কাম ও সঙ্কল্পবর্জ্জিত, এবং যাঁহার কর্ম্ম জ্ঞানাগ্নিতে দগ্ধ, তাঁহাকেই জ্ঞানিগণ পণ্ডিত বলেন। ১৯।