সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকা
দীনবন্ধুর মৃত্যুর অল্পকাল পূর্বে “কমলে কামিনী” প্রকাশিত হইয়াছিল। যখন ইহা সাধারণে প্রচারিত হয়, তখন তিনি রুগ্নশয্যায়।
আমি দীনবন্ধুর গ্রন্থ সকলের কোন সমালোচনা করিলাম না। গ্রন্থ-সমালোচনা এ প্রবন্ধে উদ্দিষ্ট নহে ; সমালোচনার সময়ও নহে। দীনবন্ধু যে সুলেখক ছিলেন, ইহা সকলেই জানেন, আমাকে বলিতে হইবে না। তিনি যে অতি সুদক্ষ রাজকর্মচারী ছিলেন, তাহাও কিঞ্চিৎ উল্লেখ করিয়াছি। কিন্তু দীনবন্ধুর একটি পরিচয়ের বাকি আছে। তাঁহার সরল, অকপট, স্নেহময় হৃদয়ের পরিচয় কি প্রকারে দিব? বঙ্গদেশে আজকাল গুণবান্ ব্যক্তির অভাব নাই, সুদক্ষ কর্মচারীর অভাব নাই, সুলেখকেরও নিতান্ত অভাব নাই, কিন্তু দীনবন্ধুর অন্তঃকরণের মত অন্তঃকরণের অভাব বঙ্গদেশে কেন-মনুষ্যলোকে-চিরকাল থাকিবে। এ সংসারে ক্ষুদ্র কীট হইতে সম্রাট্ পর্যন্ত সকলেই এক স্বভাব—অহঙ্কার, অভিমান, ক্রোধ, স্বার্থপরতা, কপটতায় পরিপূর্ণ। এমন সংসারে দীনবন্ধুর ন্যায় রত্নই অমূল্য রত্ন।
সে পরিচয় দিবারই বা প্রয়োজন কি? এই বঙ্গদেশে দীনবন্ধুকে কে বিশেষ না জানে? দারজিলিঙ্গ হইতে বরিশাল পর্যন্ত কাছাড় হইতে গঞ্জাম পর্যন্ত, ইহার মধ্যে কয়জন ভদ্রলোক দীনবন্ধুর বন্ধুমধ্যে গণ্য নহেন? কয়জন তাঁহার স্বভাবের পরিচয় না জানেন? কাহার নিকট পরিচয় দিতে হইবে?
দীনবন্ধু যেখানে না গিয়াছেন বাঙ্গালায় এমন স্থান অল্পই আছে। যেখানে গিয়াছেন সেইখানেই বন্ধু সংগ্রহ করিয়াছেন। যে তাঁহার আগমন-বার্তা শুনিত, সেই তাঁহার সহিত আলাপের জন্য উৎসুক হইত। যে আলাপ করিত, সেই তাঁহার বন্ধু হইত। তাঁহার ন্যায় সুরসিক লোক বঙ্গভূমে এখন আর কেহ আছে কি না বলিতে পারি না, তিনি যে সভায় বসিতেন, সেই সভার জীবনস্বরূপ হইতেন। তাঁহার সরস, সুমিষ্ট কথোপকথনে সকলেই মুগ্ধ হইত। শ্রোতৃবর্গ, মর্মের দুঃখ সকল ভুলিয়া গিয়া, তাঁহার সৃষ্ট হাস্যরস-সাগরে ভাসিত। তাঁহার প্রণীত গ্রন্থ সকল বাঙ্গালা ভাষায় সর্বোৎকৃষ্ট হাস্যরসের গ্রন্থ বটে, কিন্তু তাঁহার প্রকৃত হাস্যরসপটুতার শতাংশের পরিচয় তাঁহার গ্রন্থে পাওয়া যায় না। হাস্যরসাবতারণায় তাঁহার যে পটুতা, তাহার প্রকৃত পরিচয় তাঁহার কথোপকথনেই পাওয়া যাইত। অনেক সময়ে, তাঁহাকে সাক্ষাৎ মূর্তিমান হাস্যরস বলিয়া বোধ হইত। দেখা গিয়াছে যে অনেকে “আর হাসিতে পারি না” বলিয়া তাঁহার নিকট হইতে পলায়ন করিয়াছেন। হাস্যরসে তিনি প্রকৃত ঐন্দ্রজালিক ছিলেন।
অনেক লোক আছে যে, নির্বোধ অথচ অত্যন্ত আত্মাভিমানী, এরূপ লোকের পক্ষে দীনবন্ধু সাক্ষাৎ যম ছিলেন। কদাচ তাহাদিগের আত্মাভিমানের প্রতিবাদ করিতেন না, বরং সেই আগুনে সাধ্যমত বাতাস দিতেন। নির্বোধ সেই বাতাসে উন্মত্ত হইয়া উঠিত। তখন তাহার রঙ্গভঙ্গ দেখিতেন। এরূপ লোক দীনবন্ধুর হাতে পড়িলে কোনরূপে নিষ্কৃতি পাইত না।
ইদানীং কয়েক বৎসর হইল, তাঁহার হাস্যরসপটুতা ক্রমে মন্দীভূত হইয়া আসিতেছিল। প্রায় বৎসরাধিক হইল, একদিন তাঁহার কোন বিশেষ বন্ধু জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “দীনবন্ধু, তোমার সে হাস্যরস কোথা গেল? তোমার রস শুখাইতেছে, তুমি আর অধিক কাল বাঁচিবে না।” দীনবন্ধু কেবলমাত্র উত্তর করিলেন, “কে বলিল?” কিন্তু পরক্ষণেই অন্যমনস্ক হইলেন। এক দিবস আমরা একত্রে রাত্রিযাপন করি। তাঁহার রস-উদ্দীপন-শক্তি শুখাইতেছে কি না আপনি জানিবার নিমিত্ত একবার সেই রাত্রে চেষ্টা করিয়াছিলাম ; সে চেষ্টা নিতান্ত নিষ্ফল হয় নাই। রাত্রি প্রায় আড়াই প্রহর পর্যন্ত অনেকগুলি বন্ধুকে একেবারে মুগ্ধ করিয়াছিলেন। তখন জানিতাম না যে, সেই তাঁহার শেষ উদ্দীপন। তাহার পর আর কয়েক বার দিবারাত্রি একত্রে বাস করিয়াছি, কিন্তু এই রাত্রের ন্যায় আর তাঁহাকে আনন্দ-উৎফুল্ল দেখি নাই। তাঁহার অসাধারণ ক্ষমতা ক্রমে দুর্বল হইতেছিল। তথাপি তাঁহার ব্যঙ্গশক্তি একেবারে নিস্তেজ হয় নাই। মৃত্যুশয্যায় পড়িয়াও তাহা ত্যাগ করেন নাই। অনেকেই জানেন যে, তাঁহার মৃত্যুর কারণ বিস্ফোটক, প্রথমে একটি পৃষ্ঠদেশে হয়, তাহার কিঞ্চিৎ উপশম হইলেই আর একটি পশ্চাৎভাগে হইল। তাহার পর শেষ আর একটি বামপদে হইল। এই সময় তাঁহার পূর্বোক্ত বন্ধুটি কার্যস্থান হইতে তাঁহাকে দেখিতে গিয়াছিলেন। দীনবন্ধু অতি দূরবর্তী মেঘের ক্ষীণ বিদ্যুতের ন্যায় ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “ফোঁড়া এখন আমার পায়ে ধরিয়াছে।”