নবীন তপস্বিনীর পর “বিয়েপাগলা বুড়ো” প্রচার হয়। দীনবন্ধুর অনেকগুলিন গ্রন্থ প্রকৃত-ঘটনা-মূলক এবং অনেক জীবিত ব্যক্তির চরিত্র তাঁহার প্রণীত চরিত্রে অনুকৃত হইয়াছে। “নীল-দর্পণে”র অনেকগুলি ঘটনা প্রকৃত ; “নবীন তপস্বিনী”র বড় রাণী ছোট রাণীর বৃত্তান্ত প্রকৃত। “সধবার একাদশী”র প্রায় সকল নায়ক-নায়িকাগুলিন জীবিত ব্যক্তির প্রতিকৃতি ; তদ্বর্ণিত ঘটনাগুলির মধ্যে কিয়দংশ প্রকৃত ঘটনা, “জামাই-বারিকে”র দুই স্ত্রীর বৃত্তান্ত প্রকৃত। “বিয়েপাগলা বুড়ো”ও জীবিত ব্যক্তিকে লক্ষ্য করিয়া লিখিত হইয়াছিল।

প্রকৃত ঘটনা, জীবিত ব্যক্তির চরিত্র প্রাচীন উপন্যাস, ইংরেজি গ্রন্থ এবং “প্রচলিত খোসগল্প” হইতে সারাদান করিয়া দীনবন্ধু তাঁহার অপূর্ব চিত্তরঞ্জক নাটক সকলের সৃষ্টি করিতেন। নবীন তপস্বিনীতে ইহার উত্তম দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। রাজা রমণীমোহনের বৃত্তান্ত কতক প্রকৃত। হোঁদলকুঁৎকুঁতের ব্যাপারে প্রাচীন-উপন্যাসমূলক ; “জলধর” “জগদম্বা” “Merry Wives of Windsor” হইতে নীত।

বাঙ্গালি-পাঠক-মধ্যে নিতান্ত অশিক্ষিত অনেক আছেন। তাঁহারা ভাবিবেন, যদি দীনবন্ধুর গ্রন্থের মূল প্রাচীন উপন্যাসে, ইংরেজি গ্রন্থে বা প্রচলিত গল্পে আছে, তবে আর তাঁহার গ্রন্থের প্রশংসা কি? তাঁহারা ভাবিবেন, আমি দীনবন্ধুর অপ্রশংসা করিতেছি। এ সম্প্রদায়ের পাঠকদিগকে কোন কথা বুঝাইয়া বলিতে আমি অনিচ্ছুক, কেন না, জলে আলিপনা সম্ভবে না। সেক্ষপীয়রের প্রায় এমন নাটক নাই যাহা কোন প্রাচীনতর-গ্রন্থমূলক নহে। স্কটের অনেকগুলি উপন্যাস প্রাচীন কথা বা প্রাচীন-গ্রন্থমূলক। মহাভারত রামায়ণের অনুকরণ। ইনিদ্, ইলিয়দের অনুকরণ। ইহার মধ্যে কোন্ গ্রন্থ অপ্রশংসনীয়?

“সধবার একাদশী” “বিয়ে পাগলা বুড়ো”র পরে প্রকাশিত হইয়াছিল, কিন্তু উহা তৎপূর্বে লিখিত হইয়াছিল। সধবার একাদশীর যেমন অসাধারণ গুণ আছে, তেমনি অনেক অসাধারণ দোষও আছে। এই প্রহসন বিশুদ্ধ রুচির অনুমোদিত নহে, এই জন্য আমি দীনবন্ধুকে বিশেষ অনুরোধ করিয়াছিলাম যে ইহার বিশেষ পরিবর্তন ব্যাতীত প্রচার না হয়। কিছুদিন মাত্র এ অনুরোধ রক্ষা হইয়াছিল। অনেকে বলিবেন, এ অনুরোধ রক্ষা হয় নাই ভালই হইয়াছে আমরা “নিমচাঁদ”কে দেখিতে পাইয়াছি। অনেকে ইহার বিপরীত বলিবেন।

“লীলাবতী” বিশেষ যত্নের সহিত রচিত, এবং দীনবন্ধুর অন্যান্য নাটকাপেক্ষা ইহাতে দোষ অল্প। এই সময়কে দীনবন্ধুর কবিত্বসূর্যের মধ্যাহ্নকাল বলা যাইতে পারে। ইহার পর হইতে কিঞ্চিৎ তেজঃক্ষতি দেখা যায়। এরূপ উদাহরণ অনেক পাওয়া যায়। স্কট প্রথমে পদ্যগ্রন্থ লিখিতে আরম্ভ করেন। প্রথম তিনখানি কাব্য অত্যুৎকৃষ্ট হয়, “Lady of the Lake” নামক কাব্যের পর আর তেমন হইল না। দেখিয়া, স্কট পদ্য লেখা ত্যাগ করিলেন, গদ্যকাব্য লিখিতে আরম্ভ করিলেন, গদ্যকাব্য-লেখক বলিয়া স্কটের যে যশ, তাহার মূল প্রথম পনের বা ষোলখানি নবেল। “Kenilworth” নামক গ্রন্থের পর স্কটের আর কোন উপন্যাস প্রথম শ্রেণীতে স্থান পাইবার যোগ্য হয় নাই। মধ্যাহ্নের প্রখর রৌদ্রের সঙ্গে সন্ধ্যাকালীন ক্ষীণালোকের যে সম্বন্ধ, “Ivanhoe” এবং “Kenilworth” প্রভৃতির সঙ্গে স্কটের শেষ দুইখানি গদ্য-কাব্যের সেই সম্বন্ধ।

“লীলাবতী”র পর দীনবন্ধুর লেখনী কিছুকাল বিশ্রাম লাভ করিয়াছিল। সেই বিশ্রামের পর “সুরধুনী কাব্য” “জামাই-বারিক” এবং “দ্বাদশ কবিতা” অতি শীঘ্র প্রকাশিত হয়। “সুরধুনী কাব্য” অনেক দিন পূর্বে লিখিত হইয়াছিল। ইহার কিয়দংশ “বিয়েপাগলা বুড়ো”রও পূর্বে লিখিত হইয়াছিল। ইহাও প্রচার না হয়, আমি এমত অনুরোধ করিয়াছিলাম,—আমার বিবেচনায় ইহা দীনবন্ধুর লেখনীর যোগ্য হয় নাই। বোধ হয়, অন্যান্য বন্ধুগণও এইরূপ অনুরোধ করিয়াছিলেন। এইজন্য ইহা অনেক দিন অপ্রকাশ ছিল।