এই শ্লোকের তাৎপর্য্য বুঝিলে, পৃথিবীতে আর ধর্ম্মগত পার্থক্য থাকে না;-হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টীয়ান, জৈন, নিরাকারবাদী, সাকারবাদী, বহুদেবোপাসক, জড়োপাসক, সকলেই সেই এক ঈশ্বরের উপাসক-যে পথে তিনি আছেন, সেই পথে সকলেই যায়। এই শ্লোকোক্ত ধর্ম্মই জগতে একমাত্র অসাম্প্রদায়িক ধর্ম্ম। এক মাত্র সর্ব্বজনাবলম্বীয় ধর্ম্ম। ইহাও প্রকৃত হিন্দুধর্ম্ম। হিন্দুধর্ম্মের তুল্য উদার ধর্ম্ম আর নাই-আর এই শ্লোকের তুল্য উদার মহাবাক্যও আর নাই।

কাঙ্ক্ষতঃ কর্ম্মণাং সিদ্ধিং যজন্ত ইহ দেবতাঃ।
ক্ষিপ্রং হি মানুষে লোকে সিদ্ধির্ভবতি কর্ম্মজা ||১২ ||

ইহলোকে যাহারা কর্ম্মসিদ্ধি কামনা করে, তাহারা দেবগণের আরাধনা করে। এবং শীঘ্র মনুষ্যলোকেই তাহাদের কর্ম্মসিদ্ধি হয়। ১২।

অর্থাৎ সচরাচর মনুষ্য কর্ম্মফল কামনা করিয়া দেবগণের আরাধনা করে এবং ইহলোকেই সেই অভিলষিত ফল প্রাপ্ত হয়।

সে ফল সামান্য। নিষ্কাম কর্ম্মের ফল অতি মহৎ। তবে মহৎ ফলের আশা না করিয়া, লোকে সামান্য ফলের চেষ্টা করে কেন? মনুষ্যের স্বভাব যে, যে-সুখ শীঘ্র পাওয়া যাইবে, তাহা ক্ষুদ্র হইলেও তাহারই চেষ্টা করে।

চাতুর্ব্বর্ণ্যন ময়া সৃষ্টং গুণকর্ম্মবিভাগশঃ।
তস্য কর্ত্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্ত্তারমব্যয়ম্ || ১৩ ||

গুণ ও কর্ম্মের বিভাগ অনুসারে আমি চারি বর্ণ সৃষ্টি করিয়াছি বটে, কিন্তু আমি তাহার (সৃষ্টি)কর্ত্তা হইলেও আমাকে অকর্ত্তা ও বিকার-রহিত জানিও। ১৩।

হিন্দুশাস্ত্রের সাধারণ উক্তি এই যে ব্রাহ্মণবর্ণ সৃষ্টিকর্ত্তার মুখ হইতে, ক্ষত্রিয় বাহু হইতে, বৈশ্য ঊরু হইতে এবং শূদ্র চরণ হইতে সৃষ্ট হয়। কিন্তু গুণকর্ম্মবিভাগশঃ চাতুর্ব্বর্ণ্য সৃষ্ট হইয়াছে, এই কথা হিন্দুশাস্ত্রের কথিত সাধারণ উক্তির সঙ্গে আপাততঃ সঙ্গত বোধ হয় না। নানা কারণে এ কথাটার বিস্তারিত বিচার আবশ্যক।

প্রথমতঃ দেখা যায়, হিন্দুশাস্ত্রের কথিত সাধারণ উক্তির আদি বিখ্যাত পুরুষসূক্তে।

ঋগ্বেদসংহিতার দশম মণ্ডলের নবতিতম সূক্তকে পুরুষসূক্ত কহে। উহার প্রথম ঋক্ “সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ” ইত্যাদি ব্রাহ্মণগণ আজিও বিষ্ণুপূজাকালে প্রয়োগ করিয়া থাকেন। পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতগণ-যাঁহারা প্রতিপন্ন করিতে চাহেন যে, বৈদিক কালে জাতিভেদ ছিল না-তাঁহারা বলেন যে, এই সূক্ত আধুনিক। আমাদের সে বিচারে প্রয়োজন নাই। বৈদিক সূক্ত সবই অতি প্রাচীন, ইহা কোন মতেই অস্বীকার করা যায় না। আমার বলিবার কথা, ঐ সূক্তে যাহা তাহাতে ঠিক এমন বুঝায় না যে, মুখ হইতে ব্রাহ্মণ উৎপন্ন হইয়াছে, বাহু হইতে ক্ষত্রিয় উৎপন্ন হইয়াছে, ইত্যাদি। সেই ঋক্‌গুলি উদ্ধৃত করিতেছি-

“ব্রাহ্মণোহস্য মুখমাসীদ্বাহু রাজন্যঃ কৃতঃ।
ঊরু তদস্য যদ্বৈশ্যঃ পদ্ভ্যাং শূদ্রোহজায়ত ||”

শূদ্রের সম্বন্ধে “অজায়ত” বলা হইয়াছে বটে, কিন্তু ব্রাহ্মণ সম্বন্ধে বলা হইয়াছে যে, ব্রাহ্মণ সেই পুরুষের মুখ হইলেন এবং ক্ষত্রিয় বাহু (কৃত) হইলেন।80 বৈশ্য সম্বন্ধেও বলা হইয়াছে যে, ইঁহার ঊরুই বৈশ্য।

80 ডাক্তার হৌগ এই ঋক্ সম্বন্ধে লিখিয়াছেন, “Now, according to this passage, which is the most ancient and authoritative, we have on the origin of Brahmanism, and caste in general, the Brahmana has not come from the mouth of this primary being, the Purusha, but the mouth of the latter became the Brahmanichal caste, that is to say, was transformed into it. The passage has no doubt an allegorical sense. (বেদের অনেক সূক্তে তাই) Mouth is the seat of speech. The allegory points out that the Brahmans are teachers and instructors of mankind. The arms are seat of strength. If the two arms of the Purusha are said to have been made of Kshattriya (warrior), that means, then that Kshattriya have to carry arms to defend the empire. That the thighs of the Purusha were transformed into Vaishya, that, as the lower parts of the body are the principal respository of food taken, the Vaisya caste is destined to provide food for the others.” এটুকু বড় কষ্ট কল্পনা,-ঊরুতে ডাল ভাত যায় না-কিন্তু এ সকল স্থানে উদর শব্দের প্রয়োগও হিন্দুশাস্ত্রে দেখা যায়। যথা-মহাভারতের শান্তিপর্ব্বে ৪৭ অধ্যায়ে-

“ব্রহ্ম বক্তং ভুজৌ ক্ষত্রং কৃৎস্নমূরূদরং বিশ:” তার পর, “The creation of the Sudra from the feet of the Purusha indicates that he is destined to be a servant to the others, just as the foot supports the other parts of the body as a firm support.” Dr. Haug on the origin of Brahmanism, p. 4.

Dr. Muir ও বলেন “It is indeed said that the Sudra sprang from Purusha’s feet; but as regards the three superior castes and the members with which they are repectively connected, it is not quite clear which (i.e.) the castes or the members are to be taken as subjects, and which as the predicates, and consequently, whether we are to suppose verse 12, (উদ্ধৃত ঋক্) to declare that the three castes were the three members or conversely that the three members were, or became the three castes.” Sanskrit Texts, Vol. II, p. 15, 2nd edition.