শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোহপি সন্।
প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া || ৬ ||
প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া || ৬ ||
আমি অজ; আমি অব্যয়াত্মা; সর্ব্বভূতের ঈশ্বর; তাহা হইয়াও আপন প্রকৃতি বশীকৃত করিয়া আপন মায়ায় জন্মগ্রহণ করি। ৬।
অজ-জন্মরহিত।
অব্যয়াত্মা-যাঁহার জ্ঞানশক্তির ক্ষয় নাই (শঙ্কর)।
ঈশ্বর-কর্ম্মপারতন্ত্র্য-রহিত (শ্রীধর)।
প্রকৃতি-ত্রিগুণাত্মিকা মায়া, সর্ব্বজগৎ যাহার বশীভূত।
এতদ্ব্যতীত মূলে যে “অধিষ্ঠায়” শব্দ আছে, শঙ্করাচার্য্য তাহার অর্থ “বশীকৃত্য” লিখিয়াছেন, কিন্তু শ্রীধর স্বামী “স্বীকৃত্য” লিখিয়াছেন। শঙ্করকৃত ব্যাখ্যা অধিকতর সঙ্গত বলিয়া গ্রহণ করা গিয়াছে।
স্থূল কথা এই যে, ভগবানের কথায় এই আপত্তি হইতে পারে, যিনি জন্মরহিত, তাঁহার জন্ম হইল কি প্রকারে? জ্ঞানে মোক্ষ;-যাঁহার জ্ঞান অক্ষয়, তাঁহার জন্ম হইবে কেন? জন্ম কর্ম্মাধীন,-যিনি ঈশ্বর, এ জন্য কর্ম্মের অনধীন, তাঁহার জন্ম কেন?
উত্তরে ভগবান্ যাহা বলিয়াছেন, শঙ্করাচার্য্য তাহার এইরূপ অর্থ করিয়াছেন। আমার যে স্বপ্রকৃতি, অর্থাৎ সত্ত্বরজস্তম ইতি ত্রিগুণাত্মিকা বৈষ্ণবী মায়া, সমস্ত জগৎ যাহার বশে আছে, যদ্দ্বারা মোহিত হইয়া আমাকে বাসুদেব বলিয়া জানিতে পারে না, সেই প্রকৃতিকে বশীভূত করিয়া আমি জন্মগ্রহণ করি। আপনার মায়ায়-কি না, সাধারণ লোক যেমন পরমার্থনিবন্ধন জন্মগ্রহণ করে, এ সেরূপ নহে।
শ্রীধর স্বামী একটু ভিন্ন প্রকার অর্থ করিয়াছেন। তিনি বলেন, ভগবান্ বলিতেছেন যে, আমি আপনার শুদ্ধসত্ত্বাত্মিকা প্রভৃতি স্বীকার করিয়া, বিশুদ্ধ উজ্জ্বল সত্ত্বমূর্ত্তির দ্বারা স্বেচ্ছাক্রমে অবতীর্ণ হই।
কথাগুলি বড় জটিল। পাঠকের বুঝিবার সাহায্যার্থ দুই একটি কথা বলা উচিত।
“মায়া” ঈশ্বরের একটি শক্তি। এই মায়া, হিন্দুদিগের ঈশ্বরতত্ত্বে, বিশেষতঃ উপনিষদে ও দর্শনশাস্ত্রে অতি প্রধান স্থান প্রাপ্ত হইয়াছে। সাধারণতঃ বেদান্তে মায়া কিরূপে পরিচিত হইয়াছে, তাহা অনুসন্ধান করিবার আমাদের প্রয়োজন নাই। এই গীতাতেই মায়া কিরূপ বুঝান হইয়াছে, তাহাই বুঝাইতেছি। পাঠকের স্মরণ থাকিতে পারে যে, তৃতীয় অধ্যায়ের ৪২ শ্লোকের টীকায় আমরা গীতার সপ্তম অধ্যায় হইতে এই শ্লোকটি উদ্ধৃত করিয়াছিলাম,-
ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ।
অহঙ্কার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা || ৪ ||
অহঙ্কার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা || ৪ ||
ভূমি, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার, আমার ভিন্ন ভিন্ন অষ্ট প্রকার প্রকৃতি। ৪। ইহা বলিয়াই বলিতেছেন-
অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাং।
জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদাং ধার্য্যতে জগৎ || ৫ ||
জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদাং ধার্য্যতে জগৎ || ৫ ||
ইহা আমার অপরা বা নিকৃষ্টা প্রকৃতি; আমার পরা বা উৎকৃষ্ট প্রকৃতিও জান। ইনি জীবভূতা, এবং ইনি জগৎ ধারণ করিয়া আছেন। ৫।
তবে ঈশ্বরের যে শক্তি জীবস্বরূপা, এবং যাহা জগৎকে ধারণ করিয়া আছে, তাহাই তাঁহার পরা প্রকৃতি বা মায়া। আপনার জীবস্বরুপা এই শক্তিতে ভগবান্ জীবসৃষ্টি করিয়াছেন, সেই শক্তিকে বশীভূত করিয়া আপনার স্বত্বকে জীবরূপী করিতে পারেন।
ঈশ্বর শরীর ধারণপূর্ব্বক অবতীর্ণ হইতে পারেন না, ইহার বিচার নিষ্প্রয়োজন; কেন না, তিনি ইচ্ছাময় ও সর্ব্বশক্তিমান্,-পারেন না, এমন কথা বলিলে তাঁহার শক্তির সীমা নির্দ্দেশ করা হয়। ঈশ্বর শরীরী হইয়া অবতীর্ণ হওয়া সম্ভব কি না, সে স্বতন্ত্র কথা। তাহার বিচার আমি গ্রন্থান্তরে78 যথাসাধ্য করিয়াছি-পুনরুক্তির প্রয়োজন নাই। আর শরীর ধারণপূর্ব্বক ঈশ্বর অবতীর্ণ হওয়ার কোন প্রয়োজন আছে কি না, ভগবান্ নিজেই পরশ্লোকদ্বয়ে তাহা বলিতেছেন।
78 কৃষ্ণচরিত্র, প্রথম খণ্ডে।