শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
যাহা হউক, শ্লোকোক্ত পারম্পর্য্য কতক বুঝা গেল। কিন্তু বুদ্ধির আর একটি অর্থে আছে। নিশ্চয়াত্মিকা অন্তঃকরণবৃত্তিকে বুদ্ধি বলা যায়।76 এই অর্থে বুদ্ধি শব্দ যে গীতাতেই ব্যবহৃত হইয়াছে, তাহা দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেখিয়াছি। শ্লোকের অবশিষ্টাংশ বুঝিবার জন্য এই অর্থ স্মরণ করিতে হইবে। ইন্দ্রিয়দমনের উপায় কথিত হইতেছে। অন্য সমস্ত অন্তঃকরণপ্রবৃত্তি হইতে শ্রেষ্ঠ যে এই নিশ্চয়াত্মিকা বৃত্তি, পরমাত্মা তাহা হইতে শ্রেষ্ঠ।
এখন ৪৩ শ্লোক সহজে বুঝিব। এই নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধির দ্বারা সেই পরমাত্মাকে বুঝিয়া, আপনাকে নিশ্চল করিয়া কামকে পরাজিত করিতে হইবে। ইহার অপেক্ষা ইন্দ্রিয়জয়ের উৎকৃষ্ট উপায় আর কোথাও কখন কথিত হইয়াছে, এমন জানি না।77
ভীষ্মপর্ব্বণি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং
যোগশাস্ত্রে কর্ম্মযোগো নাম তৃতীয়োহধ্যায়ঃ।
76 বেদান্তসার-২৮।
77 সভ্যসমাজে মনুষ্যের একটি ইন্দ্রিয় এত প্রবল দেখা যায় যে, “ইন্দ্রিয়দোষ” বলিলে সেই ইন্দ্রিয়ের দোষই বুঝায়। ইহার প্রাবল্য নিবারণের উপায় অনেকে জিজ্ঞাসা করিয়া থাকেন, অনেকে জিজ্ঞাসু হইয়াও লজ্জার অনুরোধে প্রশ্ন করিতে পারেন না। অনেকে এমনও আছেন যে, ঈশ্বরে বিশ্বাসহীন বা তাঁহাকে নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধির দ্বারা ধারণ করিতে অক্ষম। অতএব ইন্দ্রিয়দমনের ক্ষুদ্রতর যে সকল উপায় আছে, তাহা নিম্নে লিখিত হইল।
(১) শারীরিক ব্যায়াম। ইহাতে শারীরিক ও মানসিক উভয়বিধ স্বাস্থ্য সাধিত হয়। শারীরিক ও মানসিক উভয়বিধ স্বাস্থ্য থাকিলে ইন্দ্রিয়ের দূষণীয় বেগ জন্মিতে পারে না।
(২) আহারের নিয়ম। উত্তেজক পানাহার পরিত্যাগ করিবে। মদ্যাদি বিশেষ নিষেধ। মৎস্য, মাংস একেবারে নিষেধ করা যায় না; বিশেষত: মৎস্যের অনেক সদ্গুণ আছে; কিন্তু মৎস্য ইন্দ্রিয়ের বিশেষ উত্তেজক। অতএব মৎস্য মাংসের অল্প ভোজনই ভাল। মৎস্য মাংসের এই দোষ জন্যই ব্রহ্মচারীর পক্ষে হিন্দুশাস্ত্রে নিষিদ্ধ হইয়াছে।
(৩) আলস্য পরিত্যাগ। আলস্য ইন্দ্রিয়দোষের একটি অতিশয় গুরুতর কারণ। আলস্যে কুচিন্তার অবসর পাওয়া যায়,-অন্য চিন্তার অভাব থাকিলে ইন্দ্রিয়সুখচিন্তাই বলবতী হয়। অন্য কর্ম্ম না থাকিলে, ইন্দ্রিয়পরিতৃপ্তি চেষ্টাই প্রবল হয়। যাঁহার বিষয়কর্ম্ম আছে, তিনি বিষয়কর্ম্মে বিশেষ মনোনিবেশ করিবেন এবং অবসরকালেও বিষয়কর্ম্মের উন্নতিচেষ্টা করিবেন। তাহাতে দ্বিবিধ শুভ ফল ফলিবে; ইন্দ্রিয়ও শাসিত থাকিবে এবং বিষয়কর্ম্মেরও উন্নতি ঘটিবে। তবে এরূপ বিষয়কর্ম্ম-চিন্তার দোষ এই ঘটে যে, লোক অত্যন্ত বিষয়ী হইয়া উঠে। সেটা মানসিক অবনতির কারণ হয়। অতএব যাঁহারা পারেন, তাঁহারা অবসরকালে সুসাহিত্য পাঠ বা বৈজ্ঞানিক আলোচনা করিবেন। যাঁহারা শিক্ষার অভাবে তাহাতে অক্ষম অননুরাগী, তাঁহারা আপনার কার্য্য শেষ করিয়া পরের কার্য্য করিবেন। পরিবারবর্গের সহিত কথোপকথন, বালকবালিকাদিগের বিদ্যাশিক্ষার তত্ত্বাবধান, আপনার আয়ব্যয়ের তত্ত্বাবধান এবং প্রতিবাসিগণের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের তত্ত্বাবধানের সকলেই সমস্ত অবসরকাল অতিবাহিত করিতে পারেন। ইহাতে যাঁহাদের মন না যায়, তাঁহারা কোনও গুরুতর পরকার্য্যে নিযুক্ত হইতে পারেন। অনেকে একটা স্কুল বা একটা ডাক্তারখানা স্থাপন ও রক্ষণে ব্রতী হইয়া অনেক পাপ হইতে মুক্ত হইয়াছেন।
(৪) অতি প্রধান উপায় কুসংসর্গ পরিত্যাগ। যাহারা ইন্দ্রিয়পরবশ, অশ্লীলভাষী, অশ্লীল আমোদ-প্রমোদে অনুরক্ত, তাহাদের ছায়াও পরিত্যাগ করিবে। ইহাদের দৃষ্টান্ত, প্ররোচনা ও কথোপকথনে দেবর্ষিগণও কলুষিত হইতে পারেন। সভ্য সমাজে বাসের একটি প্রধান অমঙ্গলই এই কুসংসর্গ।
(৫) সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ উপায়-কেবল ঈশ্বরচিন্তার নীচে-পবিত্র দাম্পত্য-প্রণয়। এ বিষয়ে অধিক লিখিবার প্রয়োজন নাই। এই সকল কথা যদিও গীতাব্যাখ্যার পক্ষে অপ্রাসঙ্গিক, তথাপি ইহা লোকের পক্ষে অশেষ মঙ্গলকর বলিয়া এ স্থানে লিখিত হইল।