শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
পাঠক প্রথম ৪২ শ্লোকের প্রতি মনোযোগ করুন। ইহা অনুবাদে দুর্বোধ্য।
বলা হইতেছে যে, ইন্দ্রিয়গণ শ্রেষ্ঠ বলিয়া কথিত। মন ইন্দ্রিয় হইতে শ্রেষ্ঠ, ইত্যাদি। তবে ইন্দ্রিয়গণ তাহা হইতে শ্রেষ্ঠ? ভাষ্যকারেরা বলেন, দেহাদি হইতে। তাহাই শ্লোকের অভিপ্রায় বটে, কিন্তু আধুনিক পাঠক জিজ্ঞাসা করিতে পারেন, ইন্দ্রিয় কি দেহাদি হইতে স্বতন্ত্র?
অতএব প্রথমে বুঝিতে হয়, ইন্দ্রিয় কি। দর্শনশাস্ত্রে কহে, চক্ষুঃশ্রবণাদি পাঁচটি জ্ঞানেনন্দ্রিয়, হস্তপদাদি পাঁচটি কর্ম্মেন্দ্রিয়, এবং মন অন্তরিন্দ্রিয়। কিন্তু এ শ্লোকে মনকে ইন্দ্রিয় হইতে পৃথক্ বলা হইতেছে। সুতরাং জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্ম্মেন্দ্রিয়ই এখানে অভিপ্রেত।
দেহাদি হইতে ইহা শ্রেষ্ঠ হইল কিসে? ভাষ্যকারেরা বলেন, ইন্দ্রিয় সকল সূক্ষ্ম ও প্রকাশক, দেহাদি ইন্দ্রিয়ের গ্রাহ্য। কিন্তু এ কথা কেবল জ্ঞানেন্দ্রিয় সম্বন্ধেই সত্য। আর জ্ঞানেন্দ্রিয় সকল দেহাদি হইতে স্বতন্ত্র নহে। তবে স্পষ্টতঃ ভাষ্যকারেরা দেহাদি শব্দের দ্বারা স্থূল পদার্থ বা স্থূল ভূত অভিপ্রেত করিয়াছেন। স্থূল কথা এই যে, ইন্দ্রিয়ের বিষয় হইতে ইন্দ্রিয় শ্রেষ্ঠ।
বক্তার অভিপ্রায় কি, তাহা মূলে যে “আহুঃ” পদ আছে, তাহার প্রতি মনোযোগ করিলে সন্ধান পাওয়া যাইবে। বক্তা নিজের মত বলিয়া ইহা বলিতেছেন না, এইরূপ কথিত হইয়াছে বলিয়া বলিতেছেন। কে এরূপ বলিয়াছে? সাংখ্যদর্শন স্মরণ করিলেই এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাইবে। তাহা বুঝাইতেছি।
সাংখ্যদর্শনে সমস্ত পদার্থ পঞ্চবিংশতি গণে বিভক্ত হইয়াছে। পর্য্যায়ক্রমে পঞ্চবিংশতি গণ এইরূপ।
১। প্রকৃতি। | ৪ হইতে ১৯। পঞ্চ তন্মাত্র ও একাদশ ইন্দ্রিয়। |
২। মহৎ। | ২০-২৪। পঞ্চ স্থূল ভূত। |
৩। অহঙ্কার। | ২৫ পুরুষ। |
এই পর্য্যায়ের তাৎপর্য্য এই যে, প্রকৃতি হইতে মহৎ, মহৎ হইতে অহঙ্কার, অহঙ্কার হইতে পঞ্চ তন্মাত্র ও একাদশ ইন্দ্রিয়; পঞ্চ তন্মাত্র হইতে স্থূল ভূত। পুরুষ পরমাত্মা।
এই পর্য্যায়ানুসারে স্থূল ভূত (ক্ষিত্যাদি, সুতরাং পাঞ্চভৌতিক দেহাদি) হইতে ইন্দ্রিয় শ্রেষ্ঠ। এখানে মন ইন্দ্রিয় হইতে পৃথক্; কিন্তু সাংখ্যমতানুদসারে মন ইন্দ্রিয় হইলে অন্যান্য ইন্দ্রিয় হইতে শ্রেষ্ঠ; কেন না, অন্যগুলি বহিরিন্দ্রিয়; দ্বিতীয় গণ, অহঙ্কারকে বিজ্ঞানভিক্ষু সাংখ্যপ্রবচনভাষ্যে বুদ্ধি বলিয়াছেন। অতএব বুদ্ধি মন হইতে শ্রেষ্ঠ।
কিন্তু এমন বলিতে পারা যায় না, এই সাংখ্যদর্শন গীতাপ্রণয়নকালে জন্মগ্রহণ করিয়াছিল। তবে গীতাপ্রণয়নকালে ইহা হইতে ভিন্ন প্রকার সাংখ্যমত প্রচলিত ছিল, তাহার প্রমাণ গীতাতেই আছে। তাহারই সম্প্রসারণে কপিল-প্রচারিত সাংখ্য। গীতার সপ্তমাধ্যায়ের চতুর্থ শ্লোকে এইরূপ গণ কথিত হইয়াছে,- ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ। অহঙ্কার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা || ৪ ||
আটটি মাত্র গণ কথিত হইল; পাঁচটি স্থূল ভূত, মন, বুদ্ধি এবং অহঙ্কার। শঙ্করাচার্য্য বলেন, পঞ্চ ভূতের গণনাতেই পঞ্চ তন্মাত্র এবং ইন্দ্রিয় সকলের গণনা হইল বুঝিতে হইবে।75 আর পাঠক ইহাও দেখিবেন যে, ভগবান্ বলিতেছেন যে, এই আট প্রকার আমার প্রকৃতি। অতএব কাপিল সাংখ্যের সঙ্গে এ মতের প্রভেদও অতি গুরুতর।
75 অপি চ ত্রয়োদশ অধ্যায়ে ৫।৬ শ্লোকে বলিতেছেন,
মহাভূতান্যহঙ্কারো বুদ্ধিরব্যক্তমেব চ।
ইন্দ্রিয়াণি দশৈকঞ্চ পঞ্চ চেন্দ্রিয়গোচরা: || ৫ ||
ইচ্ছা দ্বেষ: সুখং দু:খং সংঘাতশ্চেতনা ধৃতি:।
এতৎ ক্ষেত্রং সমাসেন সবিকারমুদাহৃতম্ || ৬ ||
ইহাতে কাপিল সাংখ্যের ১৩টি গণ আছে, মন ও আত্মা, আরও সাতটি আছে। ইহা গণ বা পদার্থ বলিয়া কথিত হইতেছে না; সমস্ত জগৎকে এই কয় শ্রেণীতে বিভক্ত করিবার উদ্দেশ্য নাই অতএব কপিল সাংখ্য নহে; বরং কাপিল সাংখ্যের মূল এইখানে আছে, এমন কথা বলা যাইতে পারে।
মহাভূতান্যহঙ্কারো বুদ্ধিরব্যক্তমেব চ।
ইন্দ্রিয়াণি দশৈকঞ্চ পঞ্চ চেন্দ্রিয়গোচরা: || ৫ ||
ইচ্ছা দ্বেষ: সুখং দু:খং সংঘাতশ্চেতনা ধৃতি:।
এতৎ ক্ষেত্রং সমাসেন সবিকারমুদাহৃতম্ || ৬ ||
ইহাতে কাপিল সাংখ্যের ১৩টি গণ আছে, মন ও আত্মা, আরও সাতটি আছে। ইহা গণ বা পদার্থ বলিয়া কথিত হইতেছে না; সমস্ত জগৎকে এই কয় শ্রেণীতে বিভক্ত করিবার উদ্দেশ্য নাই অতএব কপিল সাংখ্য নহে; বরং কাপিল সাংখ্যের মূল এইখানে আছে, এমন কথা বলা যাইতে পারে।