বেদে দ্যৌঃ স্বামী, পৃথিবী স্ত্রী। প্রাচীন গ্রীকদিগের মধ্যেও আকাশ স্বামী, পৃথিবী স্ত্রী। আমরা বলিয়াছি যে, এই “দ্যৌঃ” শব্দই “Zeus,” কিন্তু Zeus গ্রীকপুরাণে পৃথিবীর স্বামী নহে। গ্রীকপুরাণে Ouranos দেবের পত্নী Gaia দেবী। Gaia সংস্কৃত “গো”। গো শব্দে পৃথিবী সকলেই জানে। কিন্তু ইহার পতি Zeus নহেন, Ouranos পতি। Ouranos দ্যৌঃ নহেন-Ouranos বরুণ। বরুণও আকাশ। অতএব গ্রীকপুরাণেও আকাশ পৃথিবীর স্বামী। এবং ইহারাই সেই পুরাণমতে সর্ব্বজীবের জনক-জননী। আমাদের পাঠকেরা, দুই এক জন ছাড়া, বোধ হয় লাটিন ও গ্রীক বুঝেন না-এবং আমরাও দুর্ভাগ্যক্রমে এই অপরাধে অপরাধী। সুতরাং এ কথার পোষকতায় বচন উদ্ধৃতি করিতে পারিলাম না।*

উত্তর আমেরিকার হূরণ, ইরিকোওয়া প্রভৃতি জাতির মধ্যে, আফ্রিকার জুলুজাতি, বন্নিজাতি প্রভৃতি জাতির মধ্যে এই আকাশ-দেবতা পূজিত। উত্তর আশিয়ার সামোয়েদ জাতির মধ্যে, কিন্ জাতিদিগের মধ্যে এবং চীনজাতিদিগের মধ্যে আকাশ জনক বলিয়া প্রতিষ্ঠিত। অনেক স্থানে আকাশবাচক শব্দই ঈশ্বরবাচক শব্দ।

ঐরূপ আর্য্যজাতীয়দিগের মধ্যে, নানা অসভ্য জাতিদিগের মধ্যে এবং চৈনিক জাতিদিগের মধ্যে আকাশ পিতা, পৃথিবী মাতা, পৃথিবী আকাশের পত্নী; পৃথিবী ও আকাশের সংযোগে বা বিবাহে জীবসৃষ্টি।

চৈনিক দার্শনিকেরা ইহার উপর একটু বাড়াইলেন। আকাশ পিতা, পৃথিবী মাতা ; ইহা হইতে তাঁহারা করিলেন যে, সৃষ্টিতে দুইটি শক্তি আছে-একটি পুরুষ, একটি স্ত্রী, একটি স্বর্গীয় একটি পার্থিব। একটির নাম ইন্, আর একটির নাম ইয়ঙ্।

ইহাতে পাঠকের, ভারতবর্ষীয় প্রকৃতি পুরুষ মনে পড়িবে। ভারতবর্ষীয়েরা যে চৈনিকদিগের নিকট হইতে এ কথা পাইয়াছিলেন, অথবা চৈনিকেরা যে ভারতবর্ষীয়দিগের নিকট হইতে পাইয়াছিলেন, এমন কথা বলিবার কোন কারণ পাওয়া যায় না। বোধ হয়, দুই জাতির মধ্যে এক কারণেই এই প্রকৃতি-পুরুষতত্ত্ব উদ্ভূত হইয়াছিল। উভয় দেশেই আকাশ পিতা, পৃথিবী মাতা, এবং উভয়ের সংযোগে বিশ্বজনন, এই বিশ্বাস ছিল, তাহা হইতেই প্রকৃতি-পুরুষতত্ত্ব উদ্ভূত হইয়া থাকিবে। সাংখ্যের পুরুষ আকাশ নহে, এবং প্রকৃতি পৃথিবী নহে। তাহা আমরা জানি। বোধ হয় এই দ্যাবাপৃথিবীতত্ত্ব, উপনিষদের আত্মতত্ত্ব ও মায়াবাদে মিলিত হইয়া প্রকৃতি পুরুষে পরিণত হইয়া থাকিবে। সেই প্রকৃতি-পুরুষতত্ত্ব হইতে তান্ত্রিক উপাসনার উৎপত্তি কি না, এবং ভৈরব ও ভৈরবীর মূলে দ্যাবাপৃথিবী কি না, সে স্বতন্ত্র কথা। এক্ষণে আমরা তাহার বিচারে প্রবৃত্ত নহি।

আমরা এত দিনে যে দুইটি স্থূল কথা বুঝাইলাম, তাহা পাঠককে এইখানে স্মরণ করাইয়া দিই।

প্রথম। ইন্দ্রাদি বৈদিক দেবতা বিশ্বের নানা বিকাশ মাত্র, যথা-আকাশ, সূর্য্য, অগ্নি বা বায়ু।

দ্বিতীয়। এইরূপ ইন্দ্রাদির উপাসনা কেবল ভারতবর্ষে নহে, অনেক স্থানে আছে। এক্ষণে আমরা বিচার করিব।

প্রথম। কেন এরূপ ঘটিয়াছে।

দ্বিতীয়। এখানে উপাসনা বস্তুটা কি।

                                            ‘প্রচার’, ১ম বর্ষ, পৃ. ৩৬৩-৬৭

* এই তত্ত্বে পাঠক বুঝিতে পারিবেন, যখন আকাশ ও পৃথিবীর পরিণয় কল্পিত হইয়াছিল, তখন দ্যৌ: শব্দ জিয়স্ শব্দে পরিণত হয় নাই। তখন আর্য্যবংশীয়েরা পৃথক্ পৃথক্ দেশে যাত্রা করে নাই। অনেক কালের প্রাচীন কথা।