দেবতত্ত্ব ও হিন্দুধর্ম্ম
দ্যাবাপৃথিবী
আকাশের একটি নাম দ্যু বা দ্যৌঃ। নামটি এখনও আধুনিক সংস্কৃতে ব্যবহৃত হয়। এই দ্যু বা দ্যৌ বেদে দেবতা বলিয়া স্তুত হইয়াছেন, ইহা বলিয়াছি। ইনি একজন আকাশ-দেবতা। ইন্দ্র বৃষ্টিকারী আকাশ, বরুণ আবরণকারী আকাশ, অদিতি অনন্ত আকাশ। কিন্তু দ্যৌ বা দ্যু আকাশের কোন্ মূর্ত্তি-এ কথাটা বলা হয় নাই।
বেদে যেমন আকাশের স্তোত্র আছে, তেমনি পৃথিবীরও আছে। আকাশ দেব বলিয়া, পৃথিবী দেবী বলিয়া স্তুত হইয়াছেন। একটি কাজের কথা এই যে, এই দ্যু বা দ্যৌ, আর এই পৃথিবী, একত্রে এক সূক্তেই স্তুত হইয়াছেন। তাঁহাদের যুক্তনাম দ্যাবাপৃথিবী।
আরও কাজের কথা এই যে, কেবল তাঁহারা একত্রে স্তুত হইয়াছেন, এমত নহে, তাঁহারা দম্পতি বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। আকাশ পুরুষ, পৃথিবী স্ত্রী।
কেবল তাই নহে। এই দম্পতি সমস্ত জীবনের পিতা ও মাতা বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। দ্যৌ পিতা, পৃথিবী মাতা। আজি আমরা পৃথিবীকে মা বলিয়া থাকি-বাঙ্গালা সাহিত্যেও “মাতর্ব্বসুমতি!” এমন সম্বোধন পাওয়া যায়। কিন্তু আকাশকে পিতা বলিয়া ডাকিতে আমরা ভুলিয়া গিয়াছি। বৈদিক ঋষিরা যেমন পৃথিবীকে মাতা বলিতেন, তেমনি আকাশকে পিতা বলিতেন। “তন্মাতা পৃথিবী তৎপিতা দ্যৌঃ।” (১,৮৩,৪) এই “পিতা দ্যৌঃ” বা “দ্যৌষ্পিতা” অর্থাৎ “দ্যৌষ্পিতৃ” শব্দ গ্রীকদিগের “Zeus Pater” এবং রোমকদিগের “Jupiter” ইহা পূর্ব্বে বলা হইয়াছে।
হিন্দু দর্শনশাস্ত্রে বলে, আকাশ পঞ্চভূতের একটি। কিন্তু ইহাই আদিম। আকাশ হইতে বায়ু, বায়ু হইতে তেজঃ, তেজঃ হইতে জল, জল হইতে ক্ষিতি। ঋগ্বেদসংহিতায় দর্শনশাস্ত্র নাই-অতএব ঋগ্বেদসংহিতায় এ সকল কথা নাই। কিন্তু তাহাতে আছে যে, আকাশ হইতে সর্ব্বভূতের উৎপত্তি হইয়াছে। যথা, “দ্যাবাপৃথিবী জনিত্রী।” “দ্যৌষ্পিতা পৃথিবী মাতরধ্রূগগ্নে ভ্রাতৃর্ব্বসবো” ইত্যাদি।
তবেই, যেমন ইন্দ্র আকাশের বর্ষকমূর্ত্তি, বরুণ, আবরকমূর্ত্তি, অদিতি অনন্তমূর্ত্তি, দ্যু বা দ্যৌ তেমনি জনকমূর্ত্তি। মনুও বলিয়াছেন, “মাতা পৃথিব্যাঃ মূর্ত্তিঃ।”
এখন আধুনিক বিজ্ঞানে এমন কথা বলে না যে, আকাশ এই বিশ্বব্যাপী জীবপুঞ্জের জনক। এরূপ কথার কোন “প্রমাণ” নাই। কিন্তু বিজ্ঞান লইয়া প্রাচীন ধর্ম্ম সকল গঠিত হয় নাই। যখন বিজ্ঞান হয় নাই, তখন বিজ্ঞান কিছুরই গঠনে লাগিতে পারে না। তবে এই জনকপদে প্রতিষ্ঠিত হইবার আকাশের কি কোন দাবি দাওয়া ছিল না, তাহা আমাদের বলিবার প্রয়োজন করে না, কেবল ইহাই বলিলে যথেষ্ট হইবে যে, পৃথিবী জুড়িয়া এই দাবি স্বীকার করিয়াছিল। সকল আদিম ধর্ম্মে আকাশ জনক। অনেক ধর্ম্মে আকাশের নামে ঈশ্বরের নাম।