সেই পরবর্ত্তী শ্লোক কি, তাহা পাঠক নিম্নে জানিতে পারিবেন। তাহার ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে যদি আমরা কেহ শঙ্করাচার্য্যকৃত নবম শ্লোকের যজ্ঞ শব্দের ব্যাখ্যা গ্রহণ করিতে ইচ্ছুক না হই, তবে তাহার আর একটা সদার্থের সন্ধান করা আমাদের কর্ত্তব্য।

যজ্ঞ শব্দের মৌলিক অর্থই এখানে গ্রহণ করিলে ক্ষতি কি? যজ্ ধাতু দেবপূজার্থে। অতএব যজ্ঞের মৌলিক অর্থ দেবোপাসনা। যেখানে বহু দেবতার উপাসনা স্বীকৃত, সেখানে সকল দেবতার পূজা যজ্ঞ। কিন্তু যেখানে এক ঈশ্বরই সর্ব্বদেবময়, যথা-

“যেহপ্যন্যদেবতাভক্তা যজন্তে শ্রদ্ধয়ান্বিতাঃ।
তেহপি মামেব কৌন্তেয় যজন্ত্যবিধিপূর্ব্বকম্ ||” ২৩ ||
                                          গীতা, ৯অ।

সেখানে যজ্ঞার্থে ঈশ্বরারাধনা। ভগবান্ তাহাই স্বয়ং বলিতেছেন-

“অহং হি সর্ব্বজযজ্ঞানাং ভোক্তা চ প্রভুরেব চ।” ২৪ ||
                                           গীতা, ৯অ।

যজ্ ধাতু এবং যজ্ঞ শব্দ এইরূপ ঈশ্বরারাধনার্থে পুনঃ পুনঃ ব্যবহৃত হইয়াছে। উপরিধৃত শ্লোকে তিনটি উদাহরণ আছে। আরও অনেক দেওয়া যাইতে পারে-

“ভূতানি যান্তি ভূতেজ্যা যান্তি মদ্‌যাজিনোহপি মাম্।”
                                              গীতা, ২৫, ১০অ।
“যজ্ঞানাং জপজ্ঞোহস্মি স্থাবরাণাং হিমালয়ঃ।”
                                              গীতা, ২৫, ১০অ।

অন্য গ্রন্থেও যজ্ঞ শব্দের ঈশ্বরারাধনার্থে ব্যবহার অনেক দেখা যায়। যথা মহাভারতে-

“বাক্‌যজ্ঞেনার্চ্চিতো দেবঃ প্রীয়তাং মে জনার্দ্দন।”
                                             শান্তিপর্ব্ব, ৪৭ অধ্যায়।

এখন এই নবম শ্লোকে যজ্ঞ শব্দে ঈশ্বরারাধনা বুঝিলে কি প্রত্যবায় আছে? তাহা করিলে, এই শ্লোকের সদর্থও হয়, সুসঙ্গত অর্থও হয়।

কিন্তু যজ্ঞ শব্দের এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করিবার পক্ষে কিছু আপত্তি আছে। একটি আপত্তি এইঃ-এই শ্লোকের পরবর্ত্তী কয় শ্লোকে যজ্ঞ শব্দটি ব্যবহৃত হইয়াছে; সেখানে যজ্ঞ শব্দে ঈশ্বর, এমন অর্থ বুঝায় না। “সহযজ্ঞাঃ প্রজাঃ”, “যজ্ঞভাবিতাঃ দেবাঃ,” “যজ্ঞশিষ্টাশিনঃ,” “যজ্ঞ কর্ম্মসমুদ্ভবঃ,” “যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্” ইত্যাদি প্রয়োগে যজ্ঞ শব্দে বিষ্ণু বা ঈশ্বর বুঝাইতে পারে না। এখন ৯ম শ্লোকে যজ্ঞ শব্দ এক অর্থে ব্যবহার করিয়া,তাহার পরেই দশম, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ, চতুর্দ্দশ পঞ্চদশ শ্লোকে ভিন্নার্থে সেই শব্দ ব্যবহার করা নিতান্ত অসম্ভব।সামান্য লেখকও এরুপ করে না, গীতাপ্রণেতা যে এরুপ করিবেন, ইহা নিতান্ত অসম্ভব। হয় গীতাকর্ত্তা রচনায় নিতান্ত অপটু, নয় শঙ্করাদিকৃত যজ্ঞ শব্দের এই অর্থ ভ্রান্ত। এ দুইয়ের একটাও স্বীকার করা যায় না। যদি তা না যায়, তবে স্বীকার করিতে হইবে যে, হয় নবম হইতে পঞ্চদশ পর্য্যন্ত একার্থেই যজ্ঞ শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে, নয় নবম শ্লোকের পর একটা জোড়াতাড়া আছে।

প্রথমতঃ দেখা যাইতেছে, যজ্ঞ বিষ্ণুর নাম নয়। অভিধানে কোথাও নাই যে, যজ্ঞ বিষ্ণুর নাম। কোথাও এমন প্রয়োগও নাই। ‘হে যজ্ঞ!’ বলিলে কেহই বুঝিবে না যে, ‘হে বিষ্ণো!’ বলিয়া ডাকিতেছি। “বিষ্ণুর দশ অবতার” এ কথার পরিবর্ত্তে কখনও বলা যায় না যে, যজ্ঞের দশ অবতার”। “যজ্ঞ, শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী বনমালী” বলিলে, লোকে হাসিবে। তবে শঙ্করাচার্য্য কেন বলেন যে, যজ্ঞার্থে বিষ্ণু? কেন বলেন, তাহা তিনি বলিয়াছেন। “যজ্ঞো বৈ বিষ্ণুরিতি শ্রুতেঃ-যজ্ঞ বিষ্ণু, ইহা বেদে আছে।

শতপথব্রাহ্মণে71 কথিত আছে যে, অগ্নি, ইন্দ্র, সোম, মঘ, বিষ্ণু প্রভৃতি দেবগণ কুরুক্ষেত্রে যজ্ঞ করিয়াছিলেন। তাঁহারা যজ্ঞকালে এই প্রতিজ্ঞা করিলেন যে, আমাদিগের মধ্যে যিনি শ্রম, তপ, শ্রদ্ধা, যজ্ঞ, আহুতির দ্বারা যজ্ঞের ফল প্রথমে অবগত হইতে পারিবেন; তিনি আমাদিগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হইবেন। বিষ্ণু তাহা প্রথমে পাইলেন। তিনি দেবতাদিগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হইলেন। এক্ষণে শতপথব্রাহ্মণ হইতে উদ্ধৃত করিতেছি।

“তদ্বিষ্ণুঃ প্রথমঃ প্রাপ। স দেবানাং শ্রোষ্ঠোহভবৎ। তস্মাদাহুর্বিষ্ণুর্দেবানাং শ্রেষ্ঠ ইতি। সঃ যঃ স বিষ্ণুর্যজ্ঞঃ সঃ। স যঃ স যজ্ঞোহসৌ স আদিত্যঃ।

71 ১৪।১।১