দেবতত্ত্ব ও হিন্দুধর্ম্ম
অতএব ইন্দ্রের বাপ মার ঠিকানা হইল। সকল বস্তুর বাপ মা যে, ইন্দ্রেরও বাপ মা সেই প্রকৃতি পুরুষ। সাংখ্যের প্রকৃতি পুরুষ নহে; ইন্দ্র যখন হইয়াছেন, সাংখ্য তখন হয় নাই। প্রকৃতি অনন্তসত্তা† -পুরুষ আদি কারণ। যখন বাপ মার এরূপ পরিচয় পাইলাম, তখন এরূপ বুঝা যায় যে, ইন্দ্রও বুঝি একটা শরীরী চৈতন্য না হইবেন-প্রকৃতিতে ঐশী শক্তির বিকাশ মাত্র হইবেন। আমরা প্রথম প্রবন্ধে দেখাইয়াছি, ইন্দ্রের নামেই সে কথা স্পষ্ট বুঝা যায়। নামটা অদিতি ও কশ্যপ তাঁহার অন্নপ্রাশনের সময় রাখেন নাই, আমরাই রাখিয়াছি। আমরা যাঁহাকে ইন্দ্র বলি, তাঁহার গুণ দেখিয়াই ইন্দ্র নাম রাখিয়াছি। ইন্দ্র ধাতু বর্ষণে। তদুত্তর “র” প্রত্যয় করিয়া “ইন্দ্র” শব্দ হয়। অতএব, যিনি বৃষ্টি করেন, তিনিই ইন্দ্র। আকাশ বৃষ্টি করে, অতএব ইন্দ্র আকাশ।
আমরা অন্য প্রবন্ধে বলিয়াছি, অদিতিও আকাশ-দেবতা। আকাশকে দুই বার পৃথক্ পৃথক্ ভিন্ন ভিন্ন দেবতা কল্পনা করা কিছুই অসম্ভব নহে।* বরং আরও আকাশ-দেবতা আছে-থাকাও সম্ভব। যখন আকাশকে অনন্ত বলিয়া ভাবি, তখন আকাশ অদিতি ; যখন আকাশকে বৃষ্টিকারক বলিয়া ভবি, তখন আকাশ ইন্দ্র ; যখন আকাশকে আলোকময় ভাবি, তখন দ্যৌঃ। এমনই আকাশের আর আর মূর্ত্তি আছে। সূর্য্য অগ্নি বায়ু প্রভৃতির ভিন্ন ভিন্ন শক্তির আলোচনায় ভিন্ন ভিন্ন বৈদিক দেবের উৎপত্তি হইয়াছে, ক্রমে দেখাইব।
আমরা যদি এই কথা মনে রাখি যে, বৃষ্টিকারী আকাশই ইন্দ্র, তাহা হইলে ইন্দ্র সম্বন্ধে যত গুণ, যত উপন্যাস, বেদ, পুরাণ ও ইতিহাসে কথিত হইয়াছে, তাহা বুঝিতে পারি। এখন বুঝিতে পারি, ইন্দ্রই কেন বজ্রধর, আর কেহ কেন নহে। যিনি বৃষ্টি করেন, তিনিই বজ্রপাত করেন।
ঋগ্বেদের সূক্তগুলির সবিশেষ পর্য্যালোচনা করিলে বুঝিতে পারিব যে, কতকগুলি সূক্ত অপেক্ষাকৃত প্রাচীন, কতকগুলি অপেক্ষাকৃত আধুনিক। ইহাতে কিছুই অসম্ভব নাই, কেন না সংহিতা সঙ্কলিত গ্রন্থ মাত্র। নানা সময়ে, নানা ঋষি কর্ত্তৃক প্রণীত, না হয় দৃষ্ট মন্ত্রগুলির সংগ্রহ মাত্র। অতএব তাহার মধ্যে কোনটি পূর্ব্ববর্ত্তী, কোনটি পরবর্ত্তী অবশ্য হইবে। যে সূক্তগুলি আধুনিক, তাহাতে ইন্দ্র শরীরী, চৈতন্যযুক্ত দেবতা হইয়া পড়িয়াছেন বটে, তখন ইন্দ্রের উৎপত্তি ঋষিরা ভুলিয়া গিয়াছেন। কিন্তু প্রাচীন সূক্তগুলিতে দেখা যায় যে, ইন্দ্র যে আকাশ, এ কথা ঋষিদের মনে আছে। কতকগুলি উদাহরণ দিতেছি।
“অবর্দ্ধন্নিন্দন্দ্রমরুতশ্চিদত্র মাতা যদ্বীরং দধনদ্ধনিষ্ঠা” ১০।৭৩। ১
অর্থাৎ যখন তাঁহার ধনাঢ্যা মাতা তাঁহাকে প্রসব করিলেন, তখন মরুতেরা তাঁহাকে বাড়াইলেন। এস্থলে ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টির সম্বন্ধ সূচিত হইতেছে।
“ইন্দ্রস্য শীর্ষং ক্রতযো নিরেকে” ১০।১১২।৩
† পাঠকের স্মরণ থাকে যেন প্রথমে অদিতি অনন্তসত্তা বা প্রকৃতি নহেন-প্রথমে অদিতি অনন্ত আকাশ মাত্র। “অনন্ত” ইতিজ্ঞান, প্রথমে আকাশ হইতে জন্মিয়া পরিণামে সমস্ত সত্তায় পৌঁছে।
* মাও আকাশ, ছেলেও আকাশ, ইহাও বিস্ময়কর নহে। প্রথম যখন আকাশ “অদিতি” এবং আকাশ “ইন্দ্র” বলিয়া কল্পিত হয়, তখন ইহাদিগের মাতা পুত্র সম্বন্ধ কল্পিত হয় নাই। ঋগ্বেদে তিনি অদিতির পুত্রদিগের মধ্যে গণিত হন নাই; কেবল এক স্থানে মাত্র ঋগ্বেদে আদিত্য বলিয়া অভিহিত হইয়াছেন। সে সূক্তটিও বোধ হয় আধুনিক।
* মাও আকাশ, ছেলেও আকাশ, ইহাও বিস্ময়কর নহে। প্রথম যখন আকাশ “অদিতি” এবং আকাশ “ইন্দ্র” বলিয়া কল্পিত হয়, তখন ইহাদিগের মাতা পুত্র সম্বন্ধ কল্পিত হয় নাই। ঋগ্বেদে তিনি অদিতির পুত্রদিগের মধ্যে গণিত হন নাই; কেবল এক স্থানে মাত্র ঋগ্বেদে আদিত্য বলিয়া অভিহিত হইয়াছেন। সে সূক্তটিও বোধ হয় আধুনিক।