দিত ধাতু বন্ধনে, বা খণ্ডনে বা ছেদনে। দিতি, যাহার বন্ধন নাই, সীমা আছে, খণ্ডিত বা ছিন্ন। অদিতি, যাহার বন্ধন নাই, অখণ্ড, অচ্ছিন্ন, সীমা নাই, যে অনন্ত ; The Infinite.

এই জড় জগৎ সূর্য্য, চন্দ্র, আকাশ, মেঘ, সবই সেই অখণ্ড বা অনন্ত হইতে উৎপন্ন। পূর্ব্বে বুঝাইয়াছি, যাহা উজ্জ্বল, তাহাই দেব, সূর্য্যাদি রশ্মিময় পদার্থ দেব। তাহারা অনন্ত হইতে উৎপন্ন ; অদিতি অনন্ত, তাই অদিতি দেবমাতা; দেবতারা আদিত্য। কিন্তু সকল দেবতার মাতা যে অদিতি, ঠিক এ কথা বেদে পাওয়া যায় না। এ কথা পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক। পুরাণেতিহাসেই, বেদে অঙ্কুরিত যে হিন্দুধর্ম্ম, তাহাই সম্পূর্ণতা প্রাপ্ত হইয়াছিল। এখনকার সাহেবদিগের এবং সাহেব শিষ্যদিগের মত এই যে, পুরাণ ইতিহাস কেবল মূর্খতা, এবং ঔপধার্ম্মিকতা, ভণ্ডামি এবং নষ্টামি। বাস্তবিক বৈদিক ধর্ম্ম অপেক্ষা পৌরাণিক ধর্ম্ম অঙ্কুরের অপেক্ষা বৃক্ষের ন্যায় শ্রেষ্ঠ। তবে বৃক্ষটিতে এখন অনেক বানরের বাসা হইয়াছে বটে। ভরসা আছে, সময়ান্তরে সে কথা বুঝাইব। এক্ষণে কথাটা যাহা বলিতেছি, তাহা এইঃ-পৌরাণিকেরা বুঝিয়াছিল যে, এই অনন্ত,-অনন্ত কাল ও অনন্ত স্থিতি, অনন্ত জড়পরম্পরা, অনন্ত জীবপরম্পরা-এই অদিতি; (The Infinite in time, space and existence) ইহাই সর্ব্বপ্রসূতি। সর্ব্বপ্রসূতি বলিয়া যাহা তেজঃপুঞ্জ, যাহা সুন্দর, যাহা দীপ্তিমান, যাহা মহৎ, যাহা বলবান্-আকাশ চন্দ্র সূর্য্য বরুণ মরুৎ পর্জ্জন্য, সকলেরই প্রসূতি। তাই অদিতি দেবমাতা। কিন্তু ঋগ্বেদে অদিতির একটা বিস্তার নাই। ঋগ্বেদে অদিতি অনন্ত বটে, কিন্তু সে অনন্ত আকাশ। আকাশ অনন্ত, আকাশ অদিতি। তাই বেদে অদিতি কেবল সূর্য্যাদি আদিত্যদিগের মাতা। অদিতি যে আকাশ, তাহা বেদের অনেক স্থানেই লেখা আছে ;-যথা ঋগ্বেদের ‍১০ম মণ্ডলের ৬৩ সূক্তের ৩ ঋকে “যেভ্যো মাতা মধুমৎ পিন্বতে পয়ঃ পীযূষং দ্যৌরদিতিরদ্রিবর্হাঃ”-ইত্যাদি।

এখানে অদিতির বিশেষণ “দ্যৌঃ” শব্দ। দ্যৌঃ শব্দে আকাশ।*

অদিতি একটি প্রধানা বৈদিকী দেবী ইহা বলিয়াছি ; কিন্তু দেখিতেছি ইনি আকাশ মাত্র। ইহাকে আকাশ-দেবতা বলা যাইতে পারে। বেদের যে সকল দেবতার নাম করিয়াছি, তাহাদের মধ্যে আরও আকাশ-দেবতা পাইব। বাস্তবিক ঋগ্বেদের দেবতারা, হয়,

(১) আকাশ, যথা, অদিতি, দ্যৌস্, বরুণ (ইনি আদৌ জলেশ্বর নহেন), ইন্দ্র, পর্জ্জন্য।

(২) নয়, সূর্য্য দেবতা, যথা, সূর্য্য, মিত্র, সবিতা, পূষা, বিষ্ণু।

(৩) নয়, অগ্নি দেবতা, যথা, অগ্নি, বৃহস্পতি, ব্রহ্মণস্পতি, রুদ্র।

(৪) নয়, অন্যবিধ আলোক দেবতা, যথা, সোম, ঊষা, অশ্বীদ্বয়।

(৫) নয়, বায়ু দেবতা, যথা বায়ু, মরুদ্‌গণ।

(৬) নয়, সৃষ্টিকর্ত্তা, যথা, প্রজাপতি, হিরণ্যগর্ভ, পুরুষ, বিশ্বকর্ম্মা।

(৭) ত্বষ্টা, যম প্রভৃতি দুই চারিটি মাত্র এই শ্রেণীর বাহিরে।

                                         -‘প্রচার’, ১ম বর্ষ, পৃ. ১২৪-২৮।

* শতপথব্রাহ্মণে আছে “ইয়ং বৈ পৃথিবী অদিতি:”, এখানে যদিও পৃথিবীকে অদিতি বলা হইয়াছে, সে অনন্তার্থে। অথর্ব্ব বেদে পৃথিবী হইতে অদিতির প্রভেদ করা হইয়াছে। যথা, “ভূমির্মাতা অদিতির্নো জনিত্রং ভ্রাতান্তরীক্ষম্।” এখানে তিন লোক গণা হইল। এখানেও অদিতি স্পষ্টই আকাশ।